বসন্তী রঙে রঙিন পয়লা ফাগুন

দৈনিকবার্তা-ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: ফাল্গুনের আগুন যে মনে ধরেছে তা গত কয়েক দিনের প্রকৃতির চিত্রপটেই বোঝা যাচ্ছিল ।মৃদু মৃদু বাতাস শীতের রুক্ষতা দূর করে মনকে উদাস করে দিচ্ছিল ।হালকা মৃদু বাতাস ও বৃষ্টি হচ্ছিল দেশ জুড়ে। যা কিনা বলে শীত তাড়ানো। বছর ঘুরেই ফাল্গুনের দেখা ।

ষড়ঋতুর বাংলায় বসন্তেও রাজত্ব একেবাওে প্রকৃতি সিদ্ধ।ঋতুরাজ বসন্তের বর্ণনা কোনো রংতুলির আচরে শেষ হয়না কোনো কাব্যিক সাহিত্যেও বর্ণনায় রূপের বর্ননায় নিজেকে তৃপ্ত করতে পারেন না । তবু বসন্তেও বন্ধনায় প্রকৃতি প্রেমীদেও চেষআর অন্ত থাকে না। শনিবার পহেলা ফাল্গুন । প্রকৃতি সাজছে নতুন সাজে নতুন রূপে। গাছে গাছে ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক সন্ত তার নিজস্ব রূপ মেলে ধরে ফাগুনের আগুনে মন রাঙিয়ে বাঙিলী তার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলা, টিএসসি, অমর একুশে গ্রন্থ মেলা, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক স্মৃতিস্তম্ভ ও উত্তরার ৭নং সেক্টর পার্ক মাঠে সব বয়সী মানুষ বসন্ত বরণ উৎসবে মেতে উঠেছে।

বাসন্তি উচ্ছাস-আনন্দে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, ও নারী-পুরুষসহ সবাই বাহারি সাজে সেজে এসেছে উৎসব প্রাঙ্গণে।অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে দল বেধে ভোরেই চলে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা পরিষদের বকুলতলায়।নারীরা খোঁপায় গাদা ফুলসহ নানা রঙের ফুল আর বাসন্তী রঙের শাড়িতে এবং পুরুষেরা বাহারি রঙের পাঞ্জাবিতে সেজে এসেছেন বাঙালরির নিজস্ব এ উৎসব উদযাপনে।শুধু নবীনরাই নয়, দল বেধে এসেছেন প্রবীণরাও। এমনই একজন সবিতা রাণী (৫০)। পেশায় চিকিৎসক। তিনি জানান, আমাদের সময় এতোটা ঘটা করে বসন্ত উৎসব হতো না। কিন্তু এখন হয়। আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেয়ের সঙ্গেই এখানে এসেছি। আজ আবার সরস্বতী পূজা, তাই দু’য়ে মিলে বাড়তি আনন্দ কাজ করছে মনে।

জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের আয়োজনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে দিনব্যাপী এ উৎসবের শুভ সূচনা হয় সকাল ৭টায়চারুকলার বকুলতলায় শিল্পী মতিয়ার হোসেনের ধ্র“পদী যন্ত্রসঙ্গীত ‘সারেঙ্গী’ বাদনের মধ্য দিয়ে। চির সুন্দরের আহ্বানে ফাগুনের এ প্রথম প্রহরে আরো ছিল বসন্তকথন পর্ব, প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আবির বিনিময়, দলীয় নৃত্যসংগীত ও আবৃত্তি, একক আবৃত্তি, একক সংগীত, শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা, আদিবাসীদের পরিবেশনা এবং বসন্ত শোভাযাত্রা।অনুষ্ঠানে সমবেত কণ্ঠে শিল্পীরা গেয়ে শোনান- ওহে গৃহবাসী…, কে রঙ লাগালে বনে বনে…, ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে… প্রভৃতি গান। গান পরিবেশন করেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, লাইসা আহমেদ লিসা, ফেরদৌস আরা, মিতা হক, সালমা আকবর, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস প্রমুখ। সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যম, নটরাজ, নৃত্যনন্দন, বুলবুল ললিতকলাসহ বিভিন্ন সংগঠন। একক আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়, আহকামউল্লাহ, গোলাম সারোয়ার প্রমুখ।বেলা ১১টার দিকে বকুলতলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয় শোভাযাত্রা।বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলাসহ ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ পার্ক স্মৃতিস্তম্ভ ও উত্তরার ৭নং সেক্টরের পার্কের মাঠে বসন্ত উৎসবের দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়। এখানেও গান, নাচ, আবৃত্তিসহ নানা অঅয়োজন থাকবে।সকালের চারুকলার পর্বটি চ্যানেল আই, বিকেলের পর্বটি দীপ্ত টিভি এবং রীবন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চের পর্বটি এনটিভি সরাসরি সম্প্রচার করে।

‘ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে গান’- এমনই নানা গানে মুখরিত হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণ। বসন্ত বরণে ভোর থেকেই এখানে চলছে উৎসব। খোঁপায় নানা ফুল আর বাসন্তী রঙের শাড়িতে সেজেছেন নারীরা। আর পুরুষের পরনে বাসন্তী পাঞ্জাবি।শুধু নবীনরাই নয়, দল বেধে এসেছেন প্রবীণরাও। এমনই একজন আছমা ইসলাম (৫০)। পেশায় শিক্ষিকা। তিনি বললেন, আমাদের সময় এতোটা ঘটা করে বসন্ত উৎসব হতো না। কিন্তু এখন হয়। আমার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেয়ের সঙ্গেই এখানে এসেছি।বাদ যায়নি শিশুরাও। কেউবা এসেছে মা-বাবার সঙ্গে, কেউবা আবার ভাইবোনের সঙ্গে।এদিকে, বসন্ত উৎসবে নৃত্য পরিবেশন করেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। কবিতা আবৃত্তি করেন গোলাম সারোয়ার। শীতে ধুলোর সাগরে নুয়ে পড়া প্রকৃতির ক্লান্তি কেটে গেছে। গাছে গাছে সবুজ পাতা জেগে উঠছে আড়মোড়া ভেঙে। ফুলবাগানে রঙের ছড়াছড়ি। ভোরের হালকা শীতল বাতসে ভর করেছে সোনারোদের একটুখানি উষ্ণতা। নরম উষ্ণতা গায়ে মেখে গলা সাধছে কোকিল।বসন্ত যে এসে গেছে!পহেলা ফাল্গুন (শনিবার)। বসন্তের প্রথম দিন। ঋতুরাজ বসন্তের ছোঁয়ায় যৌবনা প্রকৃতির গায়ে যেনো লাগে শিহরণ। এলোপাথাড়ি বাতাসও ছন্দ তুলে নাচতে থাকে এসময়। ছন্দে তাল মেলায় বসন্ত ফুলের সুবাস। বসন্তে শিমুল-পলাশ শাঁখে রক্তিম আভা ছড়ায় সিঁদুরে লাল ফুল। হলদে-বাসন্তী ফুলে ছেয়ে যায় গাঁদা ফুলের গাছ। চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, মাধবীলতা আর সন্ধ্যামালতী নিজ নিজ রঙে সেজে ওঠে। কুসমকাননে প্রজাপতি আর ভ্রমরের আনাগোনা। ভালোবাসার এই তো শুরু!

বসন্ত শুধু একটি ঋতুই নয়, এটি ভালোবাসার প্রতীক। নতুন কুঁড়ি, নতুন চাঁদ, নতুন প্রেম, নতুন ভাবনা, নতুন উন্মাদনা আর নতুন উচ্ছ্বাস। পুরোনোকে নতুন করে রাঙিয়ে দিতে ফাল্গুনি রথে চড়ে আসেন বসন্তদেব।বসন্ত উৎসবের ঋতু। ভারতীয় উপমহাদেশের অনতম জনপ্রিয় বসন্ত উৎসব হচ্ছে হোলি বা দোলযাত্রা। ফাল্গুনি পূর্ণিমা তিথিতে হোলি খেলা হয়।পুরাণ অনুযায়ী, ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে আবির ও গুলাল নিয়ে রাধা ও গোপীদের সঙ্গে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই থেকে বসন্তের নতুন চাঁদের এ দিনে নানা রঙের আবির ছড়িয়ে হোলি খেলা হয়।এবারের বসন্ত প্রত্যেকের জীবনে বয়ে আনুক পরম আশির্বাদ, পূর্ণতা ও সুখ। বসন্ত বিরাজ করুক সবার মনে।

পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, মাথায় ফুলের টায়রা, কারও বা খোঁপায় হলুদ গাঁদার মালা। এক হাতে বই, অন্য হাত প্রিয় মানুষের হাতে।শনিবার ফাল্গুনের প্রথম সকাল-দুপুরে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৩তম দিনে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে।এদিন কেউ এসেছেন প্রিয়জনের হাত ধরে। আবার দল বেঁধেও এসেছেন অনেকে। বসন্তের প্রথম দিনে মেলায় লেগেছে ফাগুনের রঙ। মেলাজুড়ে যে দিকেই চোখ গেছে শুধুই যেনো হলুদ আর বাসন্তী রঙের সমারোহ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে ভীড় ।

মেলার ১৩তম দিনটি একদিকে সরকারি ছুটি, সেই সঙ্গে বসন্তেও প্রথম দিন। তাই নানা বয়সের পাঠকের পদচারণায় জমে উঠেছে মেলা। বইপ্রেমীদের মহাসমারোহে ভরে উঠেছে প্রাণের এ মেলাপ্রাঙ্গণ।

বসন্ত আর ফাল্গুনের প্রথম দিন হওয়ায় উপচে পড়া ভিড়ই আশা করছিলেন প্রকাশকরা। তাদের আশাকে নিরাশার বালুচরে না ডুবিয়ে সকাল থেকে স্রোতের মতো মানুষ প্রবেশ করেন বইমেলায়।টিএসসি থেকে আণবিক শক্তি কমিশন ও দোয়েল চত্বর থেকে পুষ্টি ভবনের গেট, বইমেলায় প্রবেশের দু’টি পথেই ছিলো দীর্ঘ লাইন। হলুদ রঙে রাঙা বইপ্রেমীদের সারিবদ্ধভাবে দেখে মনে হচ্ছিলো, এ যেনো হলুদ কোনো ফুলের বাগান।

বসন্তের ছোঁয়া যে শুধু পাঠকদের মাঝেই লেগেছে, তা কিন্তু নয়। ফাল্গুনের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলেছেন স্টলগুলোর বিক্রয়কর্মীরাও। শুধু উপচেপড়া ভিড়ই নয়, হচ্ছে প্রকাশকদের মুখে হাসি ফোটানোর মতো বিক্রিও। মেলার প্রায় প্রতিটি স্টলেই বইপ্রেমীদের ভিড়। বইপ্রেমীরা নব বসন্তের সঙ্গে নিয়েছেন নতুন বইয়ের ভাঁজ খোলা মন মাতানো গন্ধ। যাচাই-বাছাই করে কিনছেন পছন্দের লেখকের নতুন বই। দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা হয় ঐতিহ্য, অন্য প্রকাশ ও কাকলী প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে। তারা জানান, সকাল থেকে বিক্রি ভালো। তবে এদিন বিক্রি বেশি হচ্ছে প্রেমের গল্প-কবিতা ও উপন্যাসের বই।শনিবার মেলা বসে সকাল ১১টায়। দুয়ার খোলার আগেই লাইনে দাঁড়ান আগতরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বইমেলায় জনস্রোত বাড়তে থাকে। যে স্রোত প্রকাশকদের মুখে হাসিই বয়ে এনেছে।