ভোলায় তরমুজের বাম্পার ফল

ভোলায় এবারো তরমুজ চাষে বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় অনেকটা কমেছে ফসলি আবাদ। পরিবহন ও ফেরি সঙ্কটের কারণে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় অনেকটা হতাশা হয়ে পরেছেন কৃষকরা। তাই লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে কম দামে ক্ষেতে তরমুজ বিক্রি করে দিচ্ছেন তরমুজ চাষীরা। এদিকে গত বছরের তুলনায় এবারো তরমুজ চাষ অনেকটা কম হলেও ফলন হয়েছে ভালো। তবে পরিবহন ও ফেরি সংঙ্কটের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকাররা না আসায় ন্যাযমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। অপরদিকে এবছর কৃষি অফিস থেকে তেমন কোন সহযোগীতা ও পরামর্শ না পাওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা।

পূর্ব সূত্র ও জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর ভোলা জেলার ৭ উপজেলায় ১২ হাজার ৩ শ ২ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হলেও এবছর ৬ উপজেলায় চাষ হয়েছে ১০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এবছর ২ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে কম চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ভোলায় তরমুজ চাষের জন্য বিখ্যাত এলাকা চরফ্যাসন উপজেলায় গত বছর ১১ হাজার ২শ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবছর সেখানে ১ হাজার ৯ শত ৫০ হেক্টর জমিতে চাষ কমে দাড়িয়েছে ৯ হাজার ২৫০। ভোলা সদর উপজেলায় গত বছর চাষ হয়েছিল ৭শ ৫০ হেক্টর এবছর ৭০ হেক্টর বেড়ে দাড়িয়েছে ৮২০ হেক্টর, দৌলতখান উপজেলায় গত বছর চাষ হয়েছিল ১শ ৫২ হেক্টর এ বছর কমেছে ১৭ হেক্টর, বোরহানউদ্দিন উপজেলায় গত বছর ৯০ হেক্টর এবছর ১৫ হেক্টর বেড়ে দাড়িয়েছে ১০৫ হেক্টর, তজুমদ্দিন উপজেলায় গত বছরছিল ৩০ হেক্টর এবছর ৩৫ হেক্টর বেড়ে দাড়িয়েছে ৬৫ হেক্টরে, লালমোহন উপজেলায় গত বছর ৮৫ হেক্টর চাষ হলেও এবছর হয়েছে ১২৫ হেক্টরে। এছাড়া মনপুরা উপজেলায় গত বছর ১ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হলেও এবছর কোন তরমুজ চাষ হয়নী। এসকল তথ্য গত বছরের পরিসংখ্যান এবছরের হিসাব ভোলা কৃষি অফিস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে কৃষকদের সাথে আলাপ করে যানা যায়, ভোলায় এবছর আবহাওয়ার পরিবেশ কিছুটা অনুকুলে থাকায় জেলার বিভিন্ন স্থানে তরমুজের ফলন ভালো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তরমুজের ন্যাযমূল্য না পাওয়ায় অনেকটা হতাশা প্রকাশ করেছেন অধিকাংশ চাষীরা। এদিকে পরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া ফেরি চলাচলে বিরম্ভনা ও সঙ্কটের কারণে বাহির থেকে পাইকাররা না আসায় অনেকাটা লাভের আশা ছেড়ে দিয়ে কম দামে ক্ষেতে তরমুজ বিক্রি করে দিচ্ছেন।

চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের তরমুজ চাষী আনোয়ার ফরাজী বলেন, তিনি এবছর ৬ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। ফলন ও ভালো হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনা এবছর তরমুজের চাহিদা ও দাম কম থাকায় তিনি অনেকটা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, গত বছর যে তরমুজের ১০০ শত ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা করে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা জমি থেকেই ক্রয় করে নিয়ে গেছে। এবছর তা ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকার বেশি পাইকাররা বলছে না। তাই বাধ্য হয়ে কোন রকম খরচ উঠানোর জন্য বিক্রি করতে হচ্ছে।একই ইউনিয়নের আহাম্মদপুর গ্রামের তরমুজ চাষী খোকন মিয়া বলেন, তিনি এবছর ৩ একর জমিতে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে তরমুজ চাষ করেছেন। যোগাযোগ মাধ্যম ও ফেরি সঙ্কটের কারনে পরিবহন (ট্রাকের) ভাড়া দ্বি গুন হওয়ায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকাররা এবছর তরমুজ কিনতে না আসায় তাদের অনেকটা লোকসান গুণতে হবে বলে তিনি জানান।

একই এলাকার তরমুজ চাষী রত্তন মিয়া বলেন, তিনি প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ৪ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তরমুজ একটি সোখিন ফল। বিভিন্ন সময় নানান রোগে আক্রমন করে থাকে। এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ তরমুজ চাষের সাথে জড়িত। এবছর কৃষি অফিস থেকে তাদেরকে কোন প্রকার সহযোগীতা ও পরামর্শ না দেওয়া অনেকটা ফলন ও আবাদ কম হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। চারা রোপন থেকে ফলন আসা পর্যন্ত নব্বই দিন সময়ের মধ্যে এখানকার কৃষকদের কাছে কোন কৃষি আফিসার আসেননি বলেও অভিযোগ করেন অনেকে।
লালমোহনের গজারিয়া এলাকার তরমুজ চাষী সফিজল ইসলাম বলেন, তিনি এবছর ২ একর জমিতে তরমুজ চাষ করেছে। পাইকার জমিতে না ভিড় করায় তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন বাজারে তরমুজ বিক্রি করতে নিয়ে যান। সেখানেও তেমন একটা ভলো দাম না পাওয়া কোন রকম চালানের সাথে হিসাব করে বিক্রি করে জমি পরিষ্কার করছেন বলেও জানান।

ভোলা সদর উপজেলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের তরমুজ চাষী শাহে আলম বলেন, ভোলা-বরিশাল-লক্ষ্মীপুর নৌ-রুটে ফেরি চলাচল ব্যবস্থা একবারে নাজুক হয়ে পরায় তরমুজ ব্যবসায়ীরা আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। ফলে বাজারে তরমুজের সংখ্যা বারে যাওয়ায় সঠিক সময়ে বাজারজাত করতে না পারায় অনেকটা লোকসান গুণতে হবে বলেও জানান তিনি।

চরফ্যাশনের তরমুজ ব্যবসায়ী (পাইকার) আবুল কাসেম বলেন, গত বছর ঢাকা ট্রাক প্রতি ( ৩ হাজার তরমুজ নিয়ে ) ভাড়া দিতে হয়েছে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা। এবছর তা গুণতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। ফেরি সঙ্কট ও বিরম্ভনার কারণে ১০/১১ ঘণ্টায় ঢাকায় যাওয়ার কথা থাকলে সেখানে ৪/৫ দিনে ঢাকা যাওয়া যাচ্ছে না। কাচাঁ মাল চলাচলে ও ওঠা নামার কারণে অনেকাটা নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া এবছর মোকামেও তরমুজের দাম একটু কম থাকায় অন্যান্য জেলার পাইকাররা আসছে না। অনেকটা পরিবহন ও ফেরি সংঙ্কটের কারণে অনেকটা ন্যাযমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।

এদিকে ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌ-রুটে ফেরি সঙ্কট ও নব্যতার কারণে প্রতিনিয়ত ফেরি চলাচলে বিঘ্রন হচ্ছে। তার উপর মেঘনার অতি জোয়ারে পুনরায় ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌ-রুটে ফেরি ঘাট ভেঙ্গে যাওয়া বিপাকে পরেছে ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা। র্দীঘ সময় ফেরি চলাচল বন্ধ থাকার পর পুনরায় ২০ কিলোমিটার দুর বেদুরিয়া ফেরি ঘাট থেকে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্য ফেরি চলাচল শুরু করা হয়েছে। সেটিও জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে তিন ঘন্টার পথ এখন তা ঘুরে যেতে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা লাগছে।

এ ব্যাপারে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ফেরি সার্ভিসের ব্যবস্থাপক আবু আলম বলেন, পুনরায় ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ঘাট ভেঙ্গে যাওয়া ফেরি চলাচলের বিঘ্রন ঘটছে। শুরু থেকে এরুটে ৩টি ফেরি কনকচাপা, কৃষাণী ও কস্তুরী নিয়মিত চলাচল করে আসছিল। এর মধ্যে ফেরি কস্তুরী গত বৃহস্পতিবার চাঁদপুরে নিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ। আর ইঞ্জিনের সমস্যার কারণে ফেরি কৃষাণীর চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে পুনরায় ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ঘাট ভেঙ্গে যাওয়া বর্তমানে মঙ্গলবার থেকে বেদুরিয়া ফেরি ঘাট থেকে লক্ষ্মীপুরের উদ্দেশ্য ফেরি চলাচল শুরু করা হয়েছে। সেটিও জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে তিন ঘন্টার পত ঘুরে যেতে ৮ থেকে ৯ ঘন্টা সময় লাগছে। তাই ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের দুই পাড়েই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে এ জানজট থাকবেনা বলেও তিনি দাবি করেন।

ভোলা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক প্রশান্ত কুমার শাহা বলেন, ভোলা জেলায় এবছর ১০ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। জেলার অনুকুল আবহাওয়ার পরিবেশ ভালো থাকায় ফলনো ভালো হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ৫০ মেট্রিক টন হারে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। কৃষকদের মাঠ পর্যায়ে সহযোগীতা ও পরামর্শর বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কোন উপ-সহকারী যদি তার দায়িত্বে কোন অবহেলা করে থাকে তা হলে লিখিত অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফেরি সঙ্কটের বিষয়ে তিনি বলেন, ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ায় পর আমরা জেলা প্রশাসক মহোদকে অবগত করেছি। তিনি পুনরায় ফেরি সার্ভিস চালু করার জন্য আস্ত করেছেন।