স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল

বাংলাদেশে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের কথিত প্রধানের সাক্ষাৎকারকে ষড়যন্ত্র আখ্যায়িত করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন,তেমন কোনো সংগঠন বাংলাদেশে নেই।বাংলাদেশে ঘাঁটি বানিয়ে প্রতিবেশী কোনো দেশে আক্রমণের সুযোগও কাউকে দেওয়া হবে না বলে প্রত্যয় জানিয়েছেন তিনি। শুক্রবার সকালে রাজধানীর ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল এসব কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, পূর্বের ন্যায় এখনও স্পষ্ট করে বলতে চাই, আইএসের কোনো ঘাঁটি বাংলাদেশে নাই।কোনো সংগঠন বাংলাদেশ নাই।আইএসের সাময়িকী দাবিক-এ এই জঙ্গিগোষ্ঠীর বাংলাদেশ শাখার কথিত প্রধান শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে,ভূ-অবস্থানগত কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকেই ঘাঁটি বানানোর জন্য তাদের পছন্দ;ওই ঘাঁটি থেকেই তারা ভারতে হামলা চালাতে চায়।

যুদ্ধাপরাধের বিচার ও শীর্ষনেতাদের ফাঁসিতে চাপের মুখে থাকা জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা এখন আইএসে যোগ দিচ্ছেন বলেও শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের দাবি।ওই সাক্ষাৎকারের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,এটি একটি ষড়যন্ত্র, দেশী এবং আন্তর্জাতিক সেই ষড়যন্ত্রের একটি বহিঃপ্রকাশ।তিনি বলেন, বিদেশি শক্তির কিংবা কোনো বিদেশি মতাদর্শী লোকদের এখানে ঘাঁটি গেড়ে প্রতিবেশী দেশে আক্রমণ করতে দেওয়া হবে না।যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কামাল দাবি করেন, বাংলাদেশ কোনো ধরনের ক্রসফায়ার বা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই।

প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট। ইসলাম ধর্মের সত্যিকার অনুসরণে খেলাফত প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি নিয়ে এ সংগঠনের জন্ম। মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক ও সিরিয়ায় রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগে দেশ দু’টির কিছু অংশ দখল করে উগ্রপন্থি এ সংগঠন আলোচনায় আসে।যদিও এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ মদদ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এই সংগঠনের মুজাহিদদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তা দিয়েছে বলেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে এসেছে।সংবাদ মাধ্যমের বিশ্লেষণে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে যে, জঙ্গি সংগঠন আল কায়দাকে নিষ্ক্রিয় করে নতুন করে আইএস গড়ে তোলা হয়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধী যুদ্ধে তালেবান সৃষ্টি এবং সোভিয়েত বাহিনীর বিদায়ের পর আল কায়েদার সৃষ্টি হয় প্রয়াত ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে। আফগান যুদ্ধের সময় এ লাদেন ছিলেন মার্কিন বাহিনীর প্রধান মিত্র। পরে পাকিস্তানের অ্যাবোতাবাদে এক সামরিক অভিযানে সোভিয়েতবিরোধী লড়াইয়ের মিত্রকে সন্ত্রাসী অ্যাখ্যা দিয়ে হত্যা করা হয়।

ইসলাম প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে শুরুতেই হত্যা ও খুনের মহোৎসবে মেতে ওঠে সংগঠনটি। ভিন্ন ধর্মালম্বী এমনকি ইসলাম ধর্মের অনুসারীদেরও বীভৎস কায়দায় হত্যা করে ভীতি সঞ্চার করে বিশ্বজুড়ে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে ইউরোপে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, লন্ডনে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালায় আইএস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়িয়ে আইএস তাদের স্বপ্নের ইসলামী রাষ্ট্রের আওতায় বাংলাদেশ, ভারতসহ দূর প্রাচ্যের দেশগুলোকে আনার ঘোষণা দিয়েছে। কল্পনার বিশাল সাম্রাজ্যকে খেলাফত হিসেবে অভিহিত করেছে আইএস।আইএস সাময়িকী দাবেক আগামীর এ খেলাফত’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নিয়ে মাঝেমধ্যে মতামতও প্রকাশ করে। সাময়িকীর সর্বশেষ ও চতুর্দশ সংখ্যায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলকে আইএস প্রস্তাবিত খেলাফত-এর অংশ করার কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন সংগঠনের বাংলাদেশ শাখার কথিত প্রধান শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। গত বুধবার (১৩ এপ্রিল) সংগঠনের এ সাময়িকীতে শেখ আবু ইব্রাহিমের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। কথিত আইএসপ্রধানের এটি ছদ্মনাম। তার সত্যিকার পরিচয় গোপন রাখা হয়।আইএস কথিত বাংলাদেশি নেতার সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয় দাবেক-এর এই সংখ্যায় শেখ আবু ইব্রাাহিম দাবেক-কে বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আইএস-এ যোগ দিচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে থাকায় আইএসকে নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিচ্ছে জামায়াত কর্মীরা।

মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো এবং মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনার মুখে দলের নিচের পর্যায়ের কর্মীরা রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করছে বলে দাবি করেন শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ। অবশ্য ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষে বারবার বলা হচ্ছিল যে, জামায়াত দেশে জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। নেতাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী বিচার শুরু হওয়ার পর সারাদেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির পর এ দাবি আরো জোরালো হয় সরকারের পক্ষে। তবে জামায়াতের নেতারা সরকারি দলের নেতাদের এ দাবি নাকচ করে আসছেন।

পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন,আইএস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় নয়।ওই সংগঠনের প্রতি সহানুভূতিশীল বেশ কজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।এরা জঙ্গি তৎপরতার দায়ে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসারউল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। ব্যাংক ডাকাতি, ব্লগার হত্যায় এ সংগঠনের সদস্যরা জড়িত। এদের সঙ্গে আইএস এবং আল-কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে বলেও দাবি পুলিশ কর্মকর্তাদের।আইএস নেতা বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের অনেকে ইসলাম ধর্মের সঠিক পথ অনুসরণ করেন না। দলটির কঠোর সমালোচনা করে শেখ ইব্রাহিম বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের অংশীদার থাকলেও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়নি তারা।মিশর ও ইরাকে ইসলামিপন্থী দলের নেতাদের জেলে যাওয়ার উদাহরণ টেনে আইএস নেতা বলেন, আল্লাহ এই পৃথিবীতেই ধর্মচ্যুতদের শাস্তি দিয়ে থাকেন।জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল নেতা-কর্মীরা শিরক ছেড়ে বাংলার খেলাফতের সৈনিক হিসেবে যোগ দিচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকসহ শিয়া, আহমদিয়া, ভিন্ন ধর্মালম্বীদের ওপর হামলা ও হত্যায় আইএস জড়িত থাকার দায় স্বীকার করলেও সরকারের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি এ সংগঠনের অস্তিত্ব থাকার সংবাদ দৃঢ়ভাবে নাকচ করা হচ্ছে। ঠিক এ সময়ে আইএসের কথিত প্রধান বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চল নিয়ে সংগঠনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বক্তব্য দিলেন।

সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে আইএস সংগঠনের কথিত প্রধান বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে চায় আইএস। কেননা এখান থেকে প্রতিবেশি ভারত ও মিয়ানমারে তৎপরতা চালানো সহজ হবে।বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী এবং বিএনপিকে পাকিস্তানপন্থী বলে অভিহিত করেন কথিত এ আইএস নেতা।শেখ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফ বলেন, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলামকে ভালবাসলেও মুরতাদ ও নাস্তিকদের প্রভাবে কোরআন ও সুন্নাহ সঠিকভাবে মেনে চলে না।বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশিসহ বিভিন্ন ধর্মাবম্বীদের ওপর হামলা আইএস করেছে বলে দাবি করে শেখ আবু ইব্রাহিম বলেন, কাফের, দলচ্যুত, কাদিয়ানি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে এ অভিযান চালানো হয়েছে।আইএস পরিচালিত দাবেক সাময়িকীর সর্বশেষ এ সংখ্যায় প্রশিক্ষণের সময় সিরিয়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাংলাদেশি এক তরুণের নাম প্রকাশ করেছে। ওই তরুণের নাম আবু জান্দাল আল-বাঙালি। পারিবারিক পরিচয়ে বলা হয়েছে, আবু জান্দালের বাবা সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন। ওই কর্মকর্তা ২০০৯ সালে ২৫ফেব্র“য়ারি পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে বিদ্রোহের সময় নিহত হন। আবু জান্দালের আবেগঘন একটি চিঠিও সাময়িকীটি প্রকাশ করেছে। ওই চিঠিতে আবু জান্দাল ব্রাদার্স অব ইসলাম সম্বোধন করে তরুণদের আইএস সংগঠনের যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।