01-06-16-Tribunal-3

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় হবিগঞ্জের তিন ভাইয়ের মধ্যে একজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। অন্য দুজনকে দেওয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড।বুধবার বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় দেন।ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী।আসামি মহিবুর রহমানকে (৬৫) মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁর সহোদর মজিবুর রহমান (৬০) এবং তাঁদের চাচাতো ভাই আবদুর রাজ্জাককে (৬৩) আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।গত ১১ মে এই মামলার কার্যক্রম শেষে রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়েছিল। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার জন্য আজকের তারিখ ধার্য করা হয়। বুধবার রায় ঘোষণা উপলক্ষে তিন ভাইকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর এই তিন আসামির বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ গঠন করার মধ্য দিয়ে বিচার শুরু হয়। ২১ অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দেন ১২ জন। আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন সাতজন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ১০ মে থেকে দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শুরু হয়।রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর গত বছরের ১০ ফেব্র“য়ারি মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া ও তাঁর ভাই মজিবুর রহমান ওরফে আঙ্গুর মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আবদুর রাজ্জাক গত বছরের ১৯ মে গ্রেপ্তার হন।রায়ে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা চার অভিযোগের সবগুলোই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।এর মধ্যে প্রথম অভিযোগে হত্যার দায়ে মুহিবুরকে মৃত্যুদণ্ড ও তার দুই ভাইকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বাকি তিন অভিযোগে আসামিদের প্রত্যেকের ৩৭ বছর করে সাজার আদেশ দিয়েছে আদালত।রায়ে বলা হয়েছে, সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বা গুলি করে মুহিবুর রহমানের দণ্ড কার্যকর করতে পারবে।

তিন আসামি বানিয়াচং উপজেলার মহিবুর রহমান ওরফে বড় মিয়া, মুজিবুর রহমান আঙ্গুর মিয়া এবং আব্দুর রাজ্জাক রায়ের সময় কাঠগড়াতেই উপস্থিত ছিলেন।তারা তিনজনই একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। সে সময় হবিগঞ্জের কয়েকটি গ্রামে তারা যেসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ঘটান, তা এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।এই রায়ে সন্তুষ্ট নন জানিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মাসুদ রানা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, তারা আপিল করবেন।নিয়ম অনুযায়ী এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ পাবেন ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত আসামিরা।

অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, তারা যে রাজাকার ছিল তা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এই রায়ে আমরা আনন্দিত। তাদের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জাতি খুশি হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ২৪টি মামলার ৩৪ আসামির মধ্যে মোট ২৩ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হলো।যে অপরাধে যে সাজা: এ মামলায় প্রসিকিউশনের আনা চারটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম ঘটনায় হত্যা, দ্বিতীয় ঘটনায় অগ্নিসংযোগ-লুটপাট, তৃতীয় অভিযোগে ধর্ষণ এবং চতুর্থ অভিযোগে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।তিন আসামিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয় বুধবার সকাল পৌনে ৯টায়।কিছু সময় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রেখে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়। এর পরপরই তিন বিচারক আসন গ্রহণ করেন।ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের সূচনা বক্তব্যের পর ২৪০ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্ত সার পড়া শুরু করেন বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদী।এরপর বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের আরেকটি অংশ পড়েন। সবশেষে সাজা ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।

অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ের কুমুরশানা গ্রামের মহিবুর রহমানের জন্ম ১৯৫০ সালে।তার ছোট ভাই মুজিবুর রহমান জন্ম নেন ১৯৫৫ সালে।মহিবুরকে এলাকার মানুষ চেনে বড় মিয়া নামে; আর মুজিবুরের পরিচিতি আঙ্গুর মিয়া নামে।বানিয়াচংয়ের সন্দলপুর বিসি হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন মহিবুর। আর মুজিবুর খাগাউড়ার ঢুলিয়া ঘাটুয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।

তারা দুই ভাই একাত্তরে ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষের দল নেজামে ইসলামীর স্থানীয় নেতা সৈয়দ কামরুল আহসানের ঘনিষ্ঠ অনুসারী।মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। খাগাউড়া গ্রামে এমএনএ সৈয়দ কামরুল আহসানের বাড়িতে খোলা হয় রাজাকার ক্যাম্প ও টর্চার সেল।তাদের বড় ভাই কলমধর ছিলেন খাগাউড়া ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং ছোট ভাই মোস্তফা ছিলেন খাগাউড়া রাজাকার ক্যাম্পের কমান্ডার।১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীরা পুনর্বাসিত হলে মুজিবুর জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন বলে অভিযোযোগপত্রের তথ্য।

বানিয়াচংয়ের খাগাউড়ার হোসেনপুর গ্রামের মো. আবদুর রাজ্জাকের জন্ম ১৯৫২ সালে। তিনি মহিবুর-মুজিবুরের চাচাতো ভাই।রাজ্জাকের প্রতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই বলে প্রসিকিউশনের দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।চাচাতো ভাইদের মতো রাজ্জাকও তিনিও ছিলেন নেজামে ইসলামীর নেতা সৈয়দ কামরুল আহসানের অনুসারী। একাত্তরে রাজ্জাকও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে সক্রিয় হন।২০০৯ সালে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আকল মিয়ার স্ত্রী ভিংরাজ বিবি হবিগঞ্জের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই তিনজনসহ মোট ছয়জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা করেন। পরে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে আসে।প্রসিকিউশনের তদন্ত দল ২০১৪ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি তদন্ত শুরু করে। তদন্তের সময় ২১ জনের বক্তব্য শোনেন তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন।প্রসিকিউশনের আবেদনে ২০১৫ সালের ১০ ফেব্র“য়ারি ট্রাইব্যুনাল মহিবুর ও মুজিবুরের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ওইদিনই বানিয়াচং থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে স্থানীয় পুলিশ।

একই বছরের ১৭ মে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির দুইদিন পর মহিবুর-মুজিবুরের চাচাতো ভাই রাজ্জাককে মৌলভীবাজারের আথানগিরি পাহাড় রেথকে গ্রেপ্তার করা হয়।রাজ্জাককে গ্রেপ্তারের দিনই ট্রাইব্যুনালে তিনজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় প্রসিকিউশন। ট্রাইব্যুনাল ৩১ মে অভিযোগ আমলে নেয়।

অভিযোগ গঠনের মধ্যে দিয়ে গতবছর ২৯ সেপ্টেম্বর এই তিন ভাইয়ের বিচার শুরু করে আদালত। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২১ অক্টোবর। রাষ্ট্রপক্ষে ১২ জন এবং আসামিপক্ষে সাতজন সাক্ষ্য দেন এ মামলায়। শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গোলাম কিবরিয়া, পারভেজ েেহাসেন ও এম. মাসুদ রানা।প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ১১ মে আদালত মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।