attack-sniperঅবসান হলো রাজধানীর ‘হলি আর্টিসান বেকারি’ রেস্টুরেন্টে জিম্মি সংকটের। গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ওই রেস্টুরেন্টে শুক্রবার (১ জুলাই) রাত ৮টায় সন্ত্রাসীরা বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে যে জিম্মি সংকটের সৃষ্টি করে, তা শেষ হয় শনিবার (২ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে। সংকটের সমাধানে অভিযান চালায় সেনা ও নৌবাহিনী এবং ৠাব ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী। অভিযানের পর ঘটনাস্থল থেকে ১৩ জনকে জীবিত ও ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

এ পর্যায়ে পুরো ১৩ ঘণ্টার অভিযানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা।

রাত ৮টা (শুক্রবার)
রাত ৮টার দিকে রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে একদল সন্ত্রাসী। খবর পেয়ে পুলিশ-ৠাব-বিজিবি ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। ছুটে যান ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান জোনের সহকারী উপ-কমিশনার (এডিসি) আহাদুল ইসলাম, বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহ উদ্দিন খান ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলামসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা।
রাত ১০টা
ঘটনাস্থলে পৌঁছেই কর্মকর্তারা জানতে পারেন, রেস্টুরেন্টে হামলা চালিয়ে বিদেশি নাগরিকসহ বেশ কিছু লোককে জিম্মি করে রেখেছে সন্ত্রাসীরা। তৎক্ষণাৎ ওসি সালাহ উদ্দিন ও এসি রবিউল ইসলামসহ কর্মকর্তারা জিম্মিদের উদ্ধারে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা এগোতে থাকলে গুলি-বোমা ছুড়তে থাকে দুর্বৃত্তের দল। এতে গুলিবিদ্ধ হন সালাহ উদ্দিন ও রবিউলসহ বেশ কিছু পুলিশ সদস্য। তাদের উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও ইউনাইটেড হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
রাত সাড়ে ১১টা
খবর পেয়ে রাত সোয়া ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে যান র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনার শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। ভেতরে বেশ কয়েকজনকে জিম্মি করা হয়েছে। বেনজীর আহমেদ যখন কথা বলছিলেন তখন ঘটনাস্থলে পৌঁছায় স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাক্টিকস (সোয়াট) টিম। এর আগে, বন্ধ করে দেওয়া হয় কাকলী, বনানী, গুলশান ১ নং মোড়, নতুন বাজার, নর্দা থেকে গুলশান এলাকায় প্রবেশের সব পথ।
রাত ১২টা
রাত ১২টায় খবর আসে, গুলিবিদ্ধ হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ওসি সালাহ উদ্দিন মারা গেছেন। তার কিছুক্ষণ পর আসে গুলিবিদ্ধ এসি রবিউলের মৃত্যুর খবরও। এরমধ্যে গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কে বাড়তে থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি।
রাত সাড়ে ১২টা
রাত সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশের বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল, ৪টি এপিসি কার। উপস্থিত হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তখন জানানো হয়, রেস্টুরেন্টটির ভেতরে বিদেশি নাগরিকসহ ৩০ জনের বেশি মানুষকে সন্ত্রাসীরা জিম্মি করেছে।
তার আগে রাত সোয়া ১২টার দিকে রেস্টুরেন্ট পর্যবেক্ষণকারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্য জানান, বেকারিটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই আলো নিভিয়ে দেয় জিম্মিকারীরা। অন্ধকার থাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না।
রাত পৌনে ১টা
এরমধ্যে ঘটনাস্থলে জড়ো হয়ে স্বজনের খোঁজ নিতে থাকেন জিম্মি লোকদের আপনজনেরা। তখন কোনো কোনো স্বজন তাদের সঙ্গে জিম্মি কারও কারও কথা হয়েছে বলেও জানান। এমনকি তারা বাঁচার আকুতি প্রকাশ করেছেন বলেও তা বর্ণনা করেন। ওইসময় রেস্টুরেন্ট থেকে পালিয়ে আসা এককর্মী জানান, এতে থাকা অতিথিদের বেশিরভাগই বিদেশি।
রাত সোয়া ১টা
রাত সোয়া ১টার দিকে অভিযান পরিচালনার স্বার্থে ওই এলাকায় আলো জ্বালায় ফায়ার সার্ভিস। এরমধ্যে শুরু হয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের বৈঠক। এর মিনিট দশেক পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক।
রাত পৌনে ২টা
রাত পৌনে ২টার দিকে রেস্টুরেন্টের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে ভেতরের অবস্থার বিবরণ দেন কর্মচারী সুমন রেজা। তিনি জিম্মি সংকট থেকে পালিয়ে বেঁচে আসেন। সুমনই জানান, ভেতরে ৭-৮ জন সন্ত্রাসীর হামলার কথা এবং সেখানে বেশ কিছু লোকের জিম্মি হওয়ার কথা।
রাত পৌনে ৩টা (শনিবার)
রাত পৌনে ৩টার দিকে রেস্টুরেন্টটির পাশের বাড়ি থেকে আটকে পড়া দু’জনকে উদ্ধার করে আনে সোয়াট। উদ্ধার হওয়া দু’জন রেস্টুরেন্টের আর্জেন্টাইন ডিয়াগো ও বাংলাদেশি বেলারোস। সোয়াটের একটি দল বুলেট প্রুফ ঢালের সহায়তায় বাড়িটিতে ঢুকে দু’দফায় দু’জনকে উদ্ধার করে। বাহিনীর সদস্যরা একজন সামনে একজন পেছনে, আর সামনে দু’জন এভাবে চতুর্মুখী দৃষ্টি রেখে অভিযানে যান।
রাত ৩টা (শনিবার)
দুই রেস্টুরেন্টকর্মীকে উদ্ধারের পরপরই সন্দেহভাজন হিসেবে রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে দু’জনকে আটক করে ডিবি। সে দু’জন হলেন, রেস্টুরেন্টের সিকিউরিটি গার্ড হায়দার ও রান্নার সহকারী নাসির।
ভোর ৪টা (শনিবার)
জিম্মি সংকটের প্রায় আট ঘণ্টা পর রাত ৪টার দিকে অভিযানে নামে ৠাবের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী। তবে শুরুতেই অন্তত পাঁচটি সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনা যায়। ভোর ঠিক ৪টায় ভেতর থেকে গুলিবিদ্ধ একজনকে বের করে আনা হয়। এরপর ৪টা ৫ মিনিটে আরও একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়।
ভোর পৌনে ৫টা
গুলশানে হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাস।
ভোর সাড়ে ৫টা
সন্ত্রাসী হামলার পর ঢাকাজুড়ে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়। নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয় রেস্টুরেন্টকেন্দ্রিক ৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে।
সকাল সাড়ে ৭টা
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মাঠে আসে সেনাবাহিনীর বিশেষ কম্যান্ডো দল। আসে সেনাবাহিনীর ১১টি এপিসি, ১৬টি জিপ ও ৩টি ভ্যানসহ বেশ কিছু সাঁজোয়া যান। দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায় মিলিটারি পুলিশকে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী ফের অভিযানে নামে। গুলি-গ্রেনেডে প্রকম্পিত হতে থাকে গুলশান এলাকা।
সোয়া ৮টা
সোয়া ৮টার পর থামতে থাকে গুলির শব্দ। এগোতে থাকে ফায়ার ব্রিগেড। মিলতে থাকে জিম্মিদশার অবসানের ইঙ্গিত। সেনা কমান্ডোদের অভিযানের মুখে প্রায় ২০ মিনিট পর গুলির শব্দ থেমে যায়। সোয়া ৮টায় ভেতরে ঢুকতে দেখা যায় ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যদের। প্রথমেই অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা হয় কয়েকজন নারী ও শিশুকে। এরপর একাধিক আহত ব্যক্তিকে বের করে আনা হয়। এদের মধ্যে একজন বিদেশি নাগরিকও ছিলেন।
৮টা ২০ থেকে ৯টা ১৫ মিনিট
৮টা ২০ মিনিটে র‌্যাবের একটি অ্যাম্বুলেন্স বাইরে বের হয়ে যেতে দেখা যায়। ৮টা ২৭ মিনিটে এগিয়ে যায় সেনাবাহিনীর চারটি অ্যাম্বুলেন্স। ৮টা ৩৪ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মো. শফিউল হক। একইসময়ে পৌঁছান নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ ও ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান। ৮টা ৪০ মিনিটে পুলিশের একটি অ্যাম্বুলেন্স উদ্ধারকৃতদের নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে বের হয়ে যায়। ৯টা ২ মিনিটে ফের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গুলশানের ৭৯ নম্বর রোড। ৯টা ৫ মিনিটে ঘটনাস্থল থেকে নৌ ও সেনাপ্রধানদের প্রস্থান।
সোয়া ৯টার পর থেকে সমাপ্তি
৪৫ মিনিটের কমান্ডো অভিযানের পর সকাল সোয়া ৯টার দিকে মোট ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয় রেস্টুরেন্টটি থেকে। সেখান থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় অন্তত ১৩ জনকে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে একজন জাপানি নাগরিক। আর নিহতদের সবাই জঙ্গি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। অভিযান শেষ হলেও এখনও রেস্টুরেন্ট এলাকায় অবস্থান করছে সামরিক বাহিনীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। তবে দুপুর সোয়া ১টার দিকে ঘটনাস্থল ছাড়তে দেখা যায় সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যানগুলোকে।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২০ জিম্মি ও ৬ সন্ত্রাসীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রাতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)।  এছাড়া এক জাপানি এবং দুই শ্রীলঙ্কার নাগরিকসহ মোট ১৩জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

শনিবার (০২ জুলাই) সেনা সদরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সামরিক অপারেশন পরিদফতরের পরিচালক ব্রি. জেনারেল নাইম আশফাক চৌধুরী অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, অভিযানে সাত সন্ত্রাসীর মধ্যে ৬ জন নিহত ও একজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হযেছে। এছাড়াও অভিযান শেষে তল্লাশিকালে ২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। যাদের সবাইকে গতরাতেই হত্যা করা হয় এবং অধিকাংশকেই ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সরকার প্রধানের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ট’ পরিচালনা করে। গতকাল (শুক্রবার) রাত থেকে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাবসহ যৌথভাবে অপারেশন থান্ডার বোল্ট পরিচালনা করা হয়।

নাইম আশফাক চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনীর প্যারাকমান্ডোর নেতৃত্বে শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অপারেশন শুরু করে ১২-১৩ মিনিটে ঘটনাস্থলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।

‘অভিযানের মাধ্যমে ৩ বিদেশি নাগরিকসহ ১৩জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। এসময় ৬ সন্ত্রাসী নিহত ও একজন সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া অভিযান শেষে ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যাদের অধিকারংশকেই ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।’

ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত ৪টি পিস্তল, একটি ফোল্ডেডবাট একে-২২, ৪টি অবিস্ফোরিত আইআইডি, একটি ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।