আইজিপি

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম সময়ে গুলশানের হামলার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক। সোমবার দুপুরে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) আয়োজিত এক শোকসভায় তিনি এ মন্তব্য করেন।পুলিশ প্রধান বলেন, আমাদের দেশের গণমাধ্যমে বলা হয়েছে-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু অনেক উন্নত দেশের তুলনাও কম সময়ে এ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।অনেক উন্নত দেশেগুলোতে এ ধরনের হামলার ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে দুই থেকে চারদিন সময় লেগে গেছে। সেক্ষেত্রে মুম্বাই হামলায় চারদিন ও কেনিয়ায় দু’দিন লেগেছে। এসব ঘটনায় শতশত লোক মারা গেলেও কোনো জঙ্গি ধরা পড়ে নাই।কিন্তু আমরা মাত্র ১২ঘণ্টায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছি। অনেককে জীবিত উদ্ধার করেছি এবং জঙ্গি আটক করা হয়েছে,’ যোগ করেন এ কে এম শহীদুল হক।

গুলশানের ক্যাফেতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুই জনকে আটক করার কথা জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক, যদিও তাদের নাম তিনি প্রকাশ করেননি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, গুলশানে জঙ্গি দমনে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তা দায়িত্বরত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন, একই সঙ্গে সেখানে ২০ জন নিরীহ বিদেশি মারা গেছেন, আমি গভীরভাবে শোকাহত।ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইজিপি বলেন, ঘটনার সময় আমি তারাবির নামাজ পড়ছিলাম। তখন আমার ফোন বেজে ওঠে, নামাজ শেষ করে দেখি একজন ডিসি আমাকে কল করেছেন। তার ফোন কলটা ধরেই আমি জানতে পারি এই ঘটনা। তখন ঘটনাস্থলের দিকে যেতে থাকি।

ঘটনাস্থলের কাছাকাছি গেলেই ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন যে- স্যার আপনি থানায় গিয়ে বসেন, এখন ঘটনাস্থলে আসিয়েন না। আমি তখন থানায় না গিয়ে সরাসরি চলে যাই ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি, এক রুমে বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন খান এবং পাশের রুমে এসি রবিউল করিম। রবিউল গুরুতর আহত। সব ডাক্তার আর নার্সরা তাকে ঘিরে চিকিৎসা করছেন। তার হার্টবিট ওঠা-নামা করছে। এই অবস্থা দেখে আমি সেখানে থাকা হাসপাতাল পরিচালককে বললাম- যেকোনো মূল্যেই হোক আমার অফিসারদের বাঁচাতে হবে আপনি সব ডাক্তারদের এখানে ডেকে নিয়ে আসুন, আর চিকিৎসা করুন।পরক্ষণে একজন পুলিশ কর্মকর্তা এসে বললো, ওসি সালাহ উদ্দিন মারা গেছেন।

এরপর দৌড়ে যাই এসি রবিউলের কাছে, আমার সামনেই রবিউলও মারা গেলো’- আইজিপি এই কথাগুলো বলছিলেন আর চোখ বেয়ে অশ্র“ পড়ছে। শহীদুল হক বলেন, তারপরই দেখি মারুফকে আহত অবস্থায় কয়েকজন নিয়ে এসেছে। ওই সময় একের পর এক পুলিশের কর্মকর্তাকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হচ্ছিল…।তখনও কথা বলতে বলতে কাঁদছেন আইজিপি। সেই সঙ্গে পুলিশ লাইন্সের অডিটোরিয়াম থাকা প্রায় সব পুলিশ কর্মকর্তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। পুরো অডিটোরিয়ামটি যেনো শোকের ছাঁয়ায় কালো হয়ে যায়। কান্নার পর আইজিপি বলেন, সে রাতে হাসপাতালে থাকার কিছুক্ষণ পর এক পুলিশ কর্মকর্তা ফোনে বলেন যে- স্যার এখন আপনি ঘটনাস্থলে আসতে পারেন। তখন আমি ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। আইজিপি আরও বলেন, এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বার বার আমাকে ফোন করছিলেন, আর খবর নিচ্ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। সারারাত তিনি খোঁজ খবর নিয়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে পাশের একটি ভবনে বসে সব বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়। এ সময় পর্যন্ত পুলিশ চারদিক থেকে জঙ্গিদের ঘেরাও করে রাখে। আমাদের (আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী) কাজে ঝুঁকি থাকবেই, তবুও সাহসিকতার সঙ্গে তার মোকাবেলা করতে হবে। বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গিবাদ থাকবে না, সব নির্মূল করা হবে। এসি রবিউল ও ওসি সালাহ উদ্দিন দুইজনই দেশের গর্ব, সব সময় আন্তরিকতার সঙ্গে রবিউল ও সালাহ উদ্দিনের পরিবারের পাশে থাকবে পুরো পুলিশ বাহিনী। তাদের পরিবারে যাদের চাকরি প্রয়োজন তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির ব্যবস্থা করা হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ প্রধান বলেন, গুলশানের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুই জনকে আটক করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘটনায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন।

শুক্রবার রাতে গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর দেশি-বিদেশি অতিথিরা আটকা পড়েন। প্রায় ১২ ঘণ্টার পর কমান্ডো অভিযানে জিম্মি সঙ্কটের অবসান হয়। অভিযান শেষে সেনা সদস্যরা ওই ক্যাফের ভেতরে ২০ জনের জবাই করা লাশ পান, যাদের ১৭ জনই বিদেশি নাগরিক।ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আর হামলাকারীদের মধ্যে ছয়জন নিহত হয়েছে, আটক করা গেছে একজনকে। তবে তার পরিচয় জানা যায়নি।জিম্মি সঙ্কটের মধ্যেই শনিবার ভোরের আগে ওই ক্যাফের পেছন থেকে আনুমানিক ২০ বছর বয়সী এক তরুণকে ‘সন্দেহজনক আচরণের কারণে’ রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। তার পরিচয় কী, তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কি না- সে তথ্যও পুলিশ প্রকাশ করেনি।শনিবার সকালে অভিযান শেষে ওই ক্যাফে থেকে উদ্ধার জিম্মিসহ অন্তত ২৭ জনকে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে। পরে তাদের বক্তব্য শুনে যাচাই বাছাই করে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার হওয়া ১৩ জনের মধ্যে অন্তত দুইজন এখনো পুলিশ হেফাজতে আছেন। তারা হলেন তাহমিদ হাসিব খান ও নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসানাত রেজা করিম।ওই কর্মকর্তা বলেন, এই দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।শাহরিয়ার খান নামের এক ব্যবসায়ীর ছেলে তাহমিদ (২২) কানাডা থেকে দেশে ফিরে শুক্রবার ইফতার শেষে বন্ধুদের সঙ্গে হোলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়েছিলেন। আর হাসানাত করিম তার মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন বলে স্বজনরা পুলিশকে বলেছেন। সাইট ইন্টেলিজেন্সে আসা হোলি বেকারির পাঁচ হামলাকারীর ছবির মধ্যে যাদের পরিচয় ফেইসবুকে আসছে, তাদের মধ্যে নিব্রাস ইসলামও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র।

রাজারবাগে পুলিশের শোক সভায় ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, আটকদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে তার পরিচয় স্পষ্ট করেননি তিনি।অন্যদের মধ্যে র‌্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান ও জাভেদ পাটোয়ারি শোকসভায় উপস্থিত ছিলেন।