20-08-16- File Photo _ 21 August Greened Blast_BB Avenew-22

ইতিহাসের ভয়াবহতম ২১আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী রোববার।জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড হামলা দিবস পালন করবে। বার বছর আগের এইদিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে।বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য এই ভয়াবহ হামলা থেকে বেঁচে গেলেও অপর ২৪ জন নিহত হন।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের শান্তি সমাবেশে বিকেলে একটি ট্রাকের উপর অস্থায়ী মঞ্চে যখন শেখ হাসিনা বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আকস্মিক এই হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান এবং আরো ২৩ জন নেতা-কর্মী নিহত হন।

এছাড়াও এই হামলায় আরো ৪শ’ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি। দেশের বৃহৎ এই রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূণ্য করতে এ হামলা করা হয়েছিল বলে পরবর্তি সময়ে অভিযোগ করেছিলেন দলটির নেতৃবৃন্দ।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃংখলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।ঢাকা’র তৎকালিন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে এক মানব বলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে তাকে গ্রেনেড ও গুলির আঘাত থেকে রক্ষা করেন।

এদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। হীমশীতল মৃত্যুর স্পর্শ থেকে বেঁচে যাওয়া অনেকে এখনও বিশ্বাসই করতে পারেন না আসলে তারা জীবিত আছেন কি-না। মৃত্যুর এতো কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসায় হয়তো তারা নতুন জীবন পেয়েছেনÑ কিন্তু যতদিন তারা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাদের বহন করে যেতে হবে সেই দুঃস্বপ্নের মত তাড়িয়ে বেড়ানো স্মৃতিকে, হঠাৎ করে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার সেই ঘটনাকে।এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় দলের নিহত নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন- আইভি রহমান, ল্যান্স করপোরাল (অব:) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্ঝেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা). মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন এবং ইসাহাক মিয়া।

মারাত্মক আহতরা হলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, এডভোকেট সাহারা খাতুন, প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম,নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, এডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন, মামুন মল্লিক প্রমুখ।

অভিযোগ রয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হত্যাকান্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিলিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয় এ হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত পাঁচটি গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।হামলার পর তৎকালিন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ পরবর্তী তদন্তে তাদের কারো বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুকুল পরিস্থিতিতে সরকার এ হামলার পুনারায় তদন্তের নির্দেশ দিলে এবং সাড়ে তিন বছর পর বিলম্বিত পুলিশ চার্জ শিট নথিভুক্ত করা হয়। অথচ বিএনপি’র কতিপয় সংসদ সদস্য এই জঘন্য হামলাকে আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত হামলা বলে দাবি করেছিলেন।

পুনরায় তদন্তে পুলিশ এই হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ জনকে চিহ্নিত করে। অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসিতে মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান কারাগারে রয়েছে।এই মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবক্স চৌধুরী এবং সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা- সিআইডি’র সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছে।

পলাতকদের মধ্যে তারেক রহমান রয়েছে লন্ডনে, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ব্যাংককে, হানিফ এন্টারপাইজের মালিক মোহাম্মদ হানিফ কলকাতা, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোরসালীন ও তার ভাই মহিবুল মুত্তাকিন ভারতের একটি কারগারে এবং মওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থান করছে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়।জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর ও মওলানা লিটন ওরফ জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ডিএমপি’র তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার (পূর্ব) ও ডেপুটি কমিশনার (দক্ষিণ) মো. ওবায়দুর রহমান এবং খান সৈয়দ হাসানও বিদেশে অবস্থান করছে।

তবে সাবেক অভিযুক্ত হারিছ চৌধুরীর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। পলাকতকদের মধ্যে মওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু আটক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। বেশ কয়েকটি বিদেশী মিশন যেমন ব্রিটিশ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, ইউএস ফেডারেল ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং ইন্টারপোল বাংলাদেশী তদন্তকারীদের যোগ দিলেও এসব প্রতিষ্ঠান বিএনপি সরকার তাদের সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ করেছিল।এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কৌসুলি এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বাসসকে বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। জাতি দীর্ঘ প্রত্যাশিত এই মামলার রায় তিন মাসের মধ্যে দেখতে পাবেন বলে তিনি আশা করেন।তিনি বলেন, দুইজন তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জেরা সম্পন্ন হলেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দেয়া হবে এবং এজন্য প্রয়োজন দুই থেকে তিন মাস।

৪৯১ জনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ২২৪ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্পন্ন হওয়ায় তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালনের জন্য আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনসমূহ দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।দিবসটি উপলপক্ষে রোববার বিকেল ৪ টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ বেদীতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে অংশগ্রহণ করবেন।আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, সংসদ সদস্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এসময় উপস্থিত থাকবেন।এই সময় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অনুরূপ কর্মসুচিতে যোগদান করবেন।

পরে একই স্থানে শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও আহতদের সাথে সাক্ষাৎ এবং আলোচনা সভায় অংশগ্রহণ করবেন। কয়েকদিন পর পর জ্বর আসে। হঠাৎ হঠাৎ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ চমকানোর মত যন্ত্রণা। রোদে গেলে গা চুলকায়, চুলার কাছে যেতে পারি না।শরীর অবশ হয়ে পড়ে। সারা শরীরে এখন যত দাগ আছে সবই স্প্রিন্টারের।যন্ত্রণা নিয়ে কয়েক দিন পর পর চিকিৎসার জন্য দৌড়াতে হয়। কোনো সময়ের জন্য একটুও ভালো থাকি না। শুধু দু:সহ যন্ত্রণা!’উপরের এই কষ্টের কথাগুলো ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আহত এডভোকেট শাহানারা ইয়াসমিনের। গত ১২টি বছর ধরে প্রতিনিয়ত সহ্য করে যাচ্ছেন শরীরে গেঁথে থাকা স্প্রিন্টারের অসহ যন্ত্রণা।

সারাদেশে জঙ্গি হামলা ও গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে আওয়ামী লীগ। এই সমাবেশে ১ থেকে দেড় মিনিটে ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেডের অতর্কিত বিস্ফোরণ ঘটায় হামলাকারী দুর্বৃত্তরা।এই নারকীয় গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে মারা যান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন।শাহানারা ইয়াসমিনের মত আরো ৩০০ জন গ্রেনেড হামলায় আহত হন। এদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গু হয়ে গেছেন চিরতরে। আহতদের প্রায় সবাই দু:সহ স্মৃতি ও অসহনীয় শারীরিক ক্লেশ নিয়ে দিন গুজরান করছেন।

রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিপরীত পাশে আউটার সার্কুলার রোডের নিজ বাসভবনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নারকীয় অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন শাহানারা ইয়াসমিন:২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। দিনটা ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার। আমি তখন বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী সদস্য। প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সমাবেশে যোগ দিতে দলীয় কার্যালয়ের সামনে যাই। ট্রাকের গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার সমাবেশ করার জায়গা না দেওয়ায়, ট্রাকের ওপর মঞ্চ তৈরি করা হয়। পৌনে ৫টায় নেত্রী বক্তব্য দিতে মঞ্চে ওঠেন। ব্যক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ বলে মঞ্চ থেকে নামতে যাবেন ঠিক এমন সময় একজন সাংবাদিক ছুটে এসে বললেন, আপা, আমি তো ছবি পাই নি। আমি ট্রাকের গা থেকে ডান হাতটা ছেড়েছি। এরপরেই বিকট শব্দ। পরপর কয়েকবার বিকট শব্দে কেঁপে উঠলো।মনে হলো যেন আসমানটা ভেঙ্গে পড়লো।চোখভরা জল, ঘোলা চোখ নিয়েই ফিরে যান ২১ আগস্টেÑ‘ সবাই ছোটাছুটি করছে। আমার সামনে আইভি আপা বসে, তার পায়ের কাছ থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। ডান পা-টা নড়ানোর চেষ্টা করলাম, দেখি চলে না।কতক্ষণ সময় কেটে গেল বলতে পারবো না।সৈনিক লীগের সালেহ ভাই এসে বললেন, ‘আপা ওঠেন। আপনাকে বোধ হয় বাঁচাতে পারবো না।’ তখন আমার পুরো শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চোখে ছোট ছেলেটার চেহারা ভেসে উঠলো। আমি বললাম, নেত্রী বেঁচে আছেন তো?পরে আমায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে এত রোগী! তারা জানায়, চিকিৎসা হবে না। পরে শিকদার মেডিকেলে নেওয়া হয়। আমার সব কাপড় কেটে ওটিতে নিয়ে অপারেশন করা হয়।দিনে দিনে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।নেত্রীর নির্দেশে কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। ৪৬ দিন সেখানে ছিলাম।

এভাবেই ওই ভয়াবহ দিনটির দু:সহ স্মৃতি বর্ণনা করে যান শাহানারা ইয়াসমিন।দীর্ঘ ১২ বছর ধরে প্রতিনিয়ত ভুগছেন শরীরের ভিতর ঢুকে যাওয়া স্প্রিন্টারের যন্ত্রণায়। তিনি বলেন, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন এই যন্ত্রণা ভোগ করে যেতেই হবে আমাকে। ২১ আগস্ট আমার জীবনের সবচেয়ে দু:সহ দিন। তবে আওয়ামী লীগের জন্য রক্ত দিতে পারাটাও আমার জন্য গর্বের। নেত্রীর জন্য রক্ত দিতে পারা আমার জীবনের বড় পাওয়া। কোনো স্বার্থের জন্য আমি নেত্রীর কাছে যাই নি।’তিনি বলতে থাকেন: ২১ আগস্টে যারা আহত হয়েছেন, নেত্রী প্রত্যেককেই তার অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝে সহায়তা দিয়েছেন। কারো কারো জন্য মাসিক উপার্জনের ব্যবস্থা করেছেন। তবে এখানে আমার কোনো প্রাপ্তি নেই। চিকিৎসা চলাকালীন নিজের হাতে যে ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন, সেটা নিয়েছি। এরপর আর কোনো সহায়তা চাইনি। কারণ চিকিৎসা চালানোর মত খরচ আমার ছিলো। আওয়ামী লীগের জন্য রক্ত ঝরেছে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। অর্থ দিয়ে এর পরিমাপ করা যাবে না।২১ আগস্ট হামলার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেন আওয়ামী মহিলা আইনজীবী সমিতি‘র বর্তমান সভাপতি শাহানারা ইয়াসমিন।

তিনি বলেন, এই মামলায় ২২৫ জনের মধ্যে ১৫২ নম্বর স্বাক্ষী আমি ।মামলার সব কার্যক্রম শেষের দিকে। আশা করি,যে ২৪ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন, তারাসহ সবাই ন্যায় বিচার পাবেন। নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে।এদিকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন আসামী এখনো পলাতক রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেই ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বর্বোরোচিত ও ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১২তম বার্ষিকী পালিত হবে রোববার ।হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুইটি মামলার পৃথক চার্জশিটে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারি কৌঁসুলি এডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল মামলা সম্পর্কে বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন পলাতক রয়েছে।

অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম সাবেক মন্ত্রী এবং জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে এবং ৮ জন জামিনে রয়েছে ও অন্যরা বর্তমানে বিভিন্ন জেলে বন্দি রয়েছে। অপর ১৯ জন আসামী বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।পলাতক ১৯ আসামী হলো- তারেক রহমান লন্ডনে, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ ব্যাংককে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, মেজর জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে।জঙ্গিনেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (পূর্ব) এবং উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে উল্লেখ করে সূত্র জানায়, তাদের বেশির ভাগই পাকিস্তানে রয়েছে।তবে অপর অভিযুক্ত পলাতক হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু এরা দুইজন কারাবন্দি বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টুও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত।দলকে নেতৃত্বশূন্য করতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের প্রথম সারির নেতাদের হত্যার উদ্দেশে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এ জঘন্য হামলা চালানো হয়।

মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত এবং অপর ৫০০ জন আহত হয়েছে। শেখ হাসিনা ওই হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান।সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২১ আগস্টের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুইটি মামলায় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই প্রথম চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং ২১ জন হুজি নেতাকর্মীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।

পরে নতুন করে তদন্তের পরে ২০১২ সালের ৩ জুলাই অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দুইটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে। দুইটি মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২।বিএনপি-জামায়াত আমলে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচাতে মামলা ভুল পথে নিয়ে যেতে তদন্তকারীরা তদন্ত ভিন্নখাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।

অভিযুক্ত ৫২ জনের মধ্যে বিএনপি’র সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নান বর্তমানে জেলে রয়েছে।পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী এবং মামলার সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডি’র সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান এবং আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছেন।