england-wins-the-series
সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডে ম্যাচে বাংলাদেশকে ৪ উইকেটে হারিয়েছে সফরকারী ইংল্যান্ড। ফলে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতে নিলো ইংলিশরা। টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ৬ উইকেটে ২৭৭ রান করে বাংলাদেশ। জবাবে ১৩ বল হাতে রেখে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় ইংল্যান্ড।  চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের সামনে ম্যাচ জয়ের লক্ষ্য ছিলো ২৭৮। তাই ইনিংসের শুরুটা দেখে-শুনেই করে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার জেমস ভিন্স ও স্যাম বিলিংস। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফির প্রথম ওভার থেকে কোন রানই নিতে পারেননি তারা। অবশ্য পরের দিকে ব্যাট হাতে ভালোই রান তুলেন ভিন্স ও বিলিংস। ফলে ১১তম ওভারের প্রথম বলেই ৫০ রানের দেখা পেয়ে যায় ইংল্যান্ড।

ছয় বোলার ব্যবহার করেও ইংল্যান্ডের উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গতে পারছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি। তবে ১২তম ওভারে মাশরাফির ও বাংলার ক্রিকেটপ্রেমিদের মুখে হাসি ফোটান অফ-স্পিনার নাসির হোসেন। ভিন্সকে এলবিডব্লু’র ফাঁদে ফেলেন নাসির। ৩৭ বলে ৩২ রান করেন ভিন্স।  ভিন্সের আউটের পরও ইংল্যান্ডের রানের চাকা সচল ছিলো বিলিংস ও বেন ডাকেটের ব্যাটে ভর করে।  জুটিতে ওভার প্রতি প্রায় ৫ রান করে তুলতে থাকেন বিলিংস ও ডাকেট। তাই এই জুটি নিয়েও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশ শিবির। তবে ২৫তম ওভারের তৃতীয় বলে বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন মোসাদ্দেক হোসেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেয়া বিলিংসকে ৬২ রানেই থামিয়ে দেন মোসাদ্দেক। বিলিংসের ৬৯ বলের ইনিংসে ৪টি চার ও ১টি ছক্কা ছিলো। দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৭৭ বলে ৬৪ রান যোগ করেন বিলিংস ও ডাকেট।

বিলিংস ফিরে যাবার পর আবারো দলকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যান ডাকেট ও জনি বেয়ারস্টো। এই জুটিও সফলতার মুখ দেখে। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকেন তারা। ডাকেট ও বেয়ারস্টোর জুটিকে দলীয় ১৭২ রানে থামিয়ে দেন বাংলাদেশ পেসার শফিউল ইসলাম। ১৮ বলে ১৫ রান করেন বেয়ারস্টো।  নিজের প্রথম উইকেট তুলে নেয়ার পরের ওভারেই দ্বিতীয় উইকেট শিকার করেন শফিউল। এই সিরিজে অভিষেক হওয়া ডাকেট, ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরি তুলে ৬৩ রানে থামেন। ৬৮ বল মোকাবেলা করে ৪টি চার ও ১টি ছক্কা হাকান ডাকেট।  পরপর দুই ওভারে দুই উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশকে খেলার ফেরার পথ দেখান শফিউল। কিন্তু বাংলাদেশকে খেলায় ফেরার পথে কাটা হয়ে দাঁড়ান ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস ও অধিনায়ক জশ বাটলার।

বাংলাদেশ বোলারদের ওপর চড়াও হন স্টোকস ও বাটলার। দলের রানের গতি বাড়িয়ে দেন তারা। ফলে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ার অবস্থা বাংলাদেশের। তবে এসময় আবারো জ্বলে ওঠেন দ্বিতীয় ম্যাচের নায়ক টাইগার দলপতি মাশরাফি। নিজের অষ্টম ওভারের চতুর্থ বলে প্রতিপক্ষ দলপতি বাটলারের উইকেট উপড়ে ফেলেন মাশরাফি। স্টোকসের সাথে পঞ্চম উইকেটে ৪৪ বলে ৪৮ রান যোগ করেন বাটলার।পরের ওভারেই আবারো উইকেট নেন ম্যাশ। ওই ওভারের তৃতীয় বলে মঈন আলীকে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে খেলায় রাখেন টাইগার দলপতি। বাটলার ২৬ বলে ২৫ এবং মঈন ১ রান করে ফিরেন। এ সময় ইংল্যান্ডের জয়ের জন্য দরকার পড়ে ৪৫ বলে ৪২ রান। হাতে উইকেট ৪টি। এই পরিস্থিতি বেশ দেখে-শুনেই লক্ষ্যের দিকে এগোতে থাকেন স্টোকস। সঙ্গী হিসেবে ছিলেন আট নম্বরে নামা ক্রিস ওকস। বড় শট খেলার দিকে খুব মনোযোগ না দিয়ে সিঙ্গেলসের ওপরই খেলছিলেন স্টোকস ও ওকস। ফলে জুটি ভাঙ্গার সুযোগই পাচ্ছিলো না বাংলাদেশ। তবে ৪৬ দশমিক ৪ ওভারে স্টোকস-ওকসের জুটি ভেঙ্গে ম্যাচে ফেরার দারুণ এক সুযোগ পায় বাংলাদেশ। স্বাগতিক পেসার তাসকিন আহমেদের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছিলেন ওকস। কিন্তু সেটি ফেলে দেন প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো ইমরুল। ওই সময় ২১ বলে ২১ রান দরকার ছিলো ইংল্যান্ডের। তাসকিনের ওই ওভারের শেষ বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে সমীকরণটা ১৮ বলে ১৭ রানে নামিয়ে আনেন ওকস।

আর পরের ওভারেই সমীকরণের হিসাব-নিকাশ পূরণ করে ফেলেন স্টোকস ও ওকস। শফিউলের ওই ওভার থেকে ১৭ রান নিয়ে ম্যাচ ও সিরিজ নিজেদের করে ফেলেন স্টোকস ও ওকস। স্টোকস ৪৮ বলে ৪৭ ও ওকস ১৮ বলে ২৭ রান করেন। বাংলাদেশের মাশরাফি ও শফিউল ২টি করে উইকেট নেন। ম্যাচের সেরা হয়েছেন ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ। আর সিরিজ সেরা হন একই দলের বেন স্টোকস।  ওয়ানডে সিরিজ শেষে এবার দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড। চট্টগ্রামের এই ভেন্যুতেই আগামী ২০ অক্টোবর থেকে শুরু হবে সিরিজের প্রথম টেস্ট। মূল লড়াইয়ে নামার আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) একাদশের বিপক্ষে দু’টি প্রস্তুতিমূলক ম্যাচ খেলবে ইংল্যান্ড।  এর আগে গতকাল থেকেই চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টির কারণে তৃতীয় ওয়ানডে হওয়া নিয়ে শংকা ছিলো। তবে দুপুরের পর থেকে বৃষ্টির তেজ কমে গেলে এবং গ্র্যাউন্ডসম্যানদের অদম্য পরিশ্রমে অবশেষে নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পর টস করতে নামেন বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের দুই অধিনায়ক।

আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে গতকালই টস বড় ফ্যাক্টর জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু প্রথম দুই ওয়ানডের মত এবারও টস ভাগ্যে হারেন ম্যাশ। ফলে টস জিতে প্রথমে বোলিং বেছে নেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক জশ বাটলার।
তবে ব্যাটিং-এ নেমে স্বাচ্ছেন্দ্যেই ব্যাট চালিয়েছেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। উইকেটের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিয়ে রানের চাকা সচল রাখেন তারা। ফলে ১১তম ওভারের পঞ্চম বলেই বাংলাদেশের স্কোর অর্ধশত স্পর্শ করে।
দলীয় স্কোর ৫০ পূর্ণ করেও সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন তামিম ও ইমরুল। তাতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে নতুন রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। ইংলিশদের বিপক্ষে বাংলাদেশ ওপেনাদের আগের সর্বোচ্চ জুটি ছিলো ৬৩ রান। ২০১০ সালে ঢাকায় এই রান করেছিলেন তামিম ও ইমরুলই।  নতুন রেকর্ড গড়ে এবার ৮০ রান পর্যন্ত যেতে সক্ষম হন তামিম ও ইমরুল। ১৯তম ওভারের শেষ বলে ইমরুল ফিরে গেলে দলীয় ৮০ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ৪টি চার ও ১ ছক্কায় ৫৮ বলে ৪৬ রান করেন প্রথম ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ইমরুল।

এরপর তামিমের সাথে উইকেটে যোগ দেন সাব্বির রহমান। এই জুটিও ইংল্যান্ড বোলারদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে খেলছিলেন। কিন্তু দলীয় ১০৬ রানে বিদায় নেন তামিম। ইংল্যান্ড লেগ স্পিনার আদিল রশিদের গুগলি কাভার দিয়ে মারতে গিয়ে আউট হন তিনি। ৫টি চারের সহায়তায় ৬৮ বলে ৪৫ রান করেন তামিম। আর ৩৮ রানের সময় ওয়ানডে ক্রিকেটে ৫’হাজার রানের মাইলফলকও স্পর্শ করেন তামিম।  তামিমের বিদায়ের পর দ্রুত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকেও হারায় বাংলাদেশ। ৬ রান করে তিনিও শিকার হন রশিদের। তামিমের মতো একই শট খেলতে গিয়ে আউট মাহমুদুল্লাহ। দলীয় ১২২ রানে মাহমুদুল্লাহ বিদায় নেয়ার পর ২২ গজে সাব্বিরের সঙ্গী মুশফিকুর। দু’জনের ব্যাটিং নৈপুন্য বাংলাদেশের বড় স্কোরের পথটা মসৃনই হচ্ছিলো। সেই সাথে রান রেটও বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন সাব্বির ও মুশফিকুর। ৮ ওভারে ৫৪ রান যোগও করেন তারা।

কিন্তু হাফ-সেঞ্চুরি থেকে ১ রান দূরে থাকতে বিদায় নেন সাব্বির। তিনিও শিকার হন রশিদের। তার ৪৬ বলের ইনিংসে ৫টি চার ছিলো। দলীয় ১৭৬ রানে সাব্বিরের বিদায় যেন, বাংলাদেশের জন্য বিপদই ডেকে আনে। কারন এরপর ১৮৪ ও ১৯২ রানে যথাক্রমে সাকিব আল হাসান এবং নাসির হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উইকেট হারায় বাংলাদেশ। দু’জনই ৪ রান করে ফিরেছেন। সাকিবকে শিকার করেন ইংল্যান্ডের আরেক স্পিনার মঈন আলী। আর নাসির ফিরেন রশিদের ফুলটস বল মারতে গিয়ে। ৩৮ দশমিক ১ ওভারে ৬ ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় বাংলাদেশ। তাতে টাইগারদের বড় স্কোরের আশা অনেকাংশেই ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু সেই ফিকে আশাকে আলোকিত করেছেন মুশফিকুর রহিম ও মোসাদ্দেক হোসেন। সপ্তম উইকেটে দুর্দান্ত এক জুটি গড়েন মুশফিক ও মোসাদ্দেক। জুটির শুরুতে কিছুটা সর্তকতার সাথেই খেলছিলেন তারা। এরপর পরিস্থিতি নিজের আয়ত্বে নিয়ে ইংল্যান্ডের বোলারদের উপর চড়াও হন দু’জনেই। তাতে বড় স্কোরে গিয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের স্কোর।  ওভারপ্রতি ৭ দশমিক ১৮ রান করে নিয়ে সপ্তম উইকেটে ৭১ বলে অবিচ্ছিন্ন ৮৫ রান যোগ করেন মুশফিক ও মোসাদ্দেক। ফলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সপ্তম উইকেট জুটিতে নতুন রানের রেকর্ড গড়েন তারা। আগের ৭৬ রানে জুটির রেকর্ডটি ২০০৫ সালে ওভালে গড়েছিলেন আফতাব আহমেদ ও মোহাম্মদ রফিক।

মুশফিক ও মোসাদ্দেকের ৮৫ রানের জুটির কল্যাণে বাংলাদেশের স্কোর পৌছায় ৬ উইকেটে ২৭৭ রানে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২৩তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে ৬৭ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিকুর। ছক্কা হাকিয়ে হাফ-সেঞ্চুরি করা মুশফিকুরের ৬২ বলের ইনিংসে ৪টি চার ও ১টি ছক্কার মার ছিলো। আরেক অপরাজিত ব্যাটসম্যান মোসাদ্দেক করেন ৩৯ বলে ৩৮ রান। তার ইনিংসে ৪টি বাউন্ডারি ছিলো। ইংল্যান্ডের পক্ষে রশিদ ৪৩ রানে ৪ উইকেট নেন। এই ইনিংসেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫০ উইকেট পূর্ণ করেন রশিদ।

স্কোর কার্ড :
বাংলাদেশ ইনিংস:
তামিম ইকবাল ক ভিন্স ব রশিদ ৪৫
ইমরুল কায়েস বদলী (ডসন) ব স্টোকস ৪৬
সাব্বির রহমান ক বাটলার ব রশিদ ৪৯
মাহমুদুল্লাহ ক বেয়ারস্টো ব রশিদ ৬
মুশফিক অপরাজিত ৬৭
সাকিব স্টাম্পড বাটলার ব আলী ৪
নাসির ভিন্স ব রশিদ ৪
মোসাদ্দেক হোসেন অপরাজিত ৩৮
অতিরিক্ত( বা-৪, লেবা-৩, ও-১১) ১৮
মোট : (৫০ ওভার, ৬ উইকেট ) রানÑ ২৭৭
উইকেট পতন : ১/৮০, ১০৬, ৩/১২২, ৪/১৭৬, ৫/১৮৪, ৬/ ১৯২
বোলিং :
ক্রিস ওকস ৮-০-৬৬-০(ও-২),
জ্যাক বল ৮-০-৪৪-০,
লিয়াম প্লাঙ্কেট ০-৯-৫১-০(ও-২)
মঈন আলী ১০-০-৪২-১(ও-১),
বেন স্টোকস ৫-০-২৪-১(ও-৪),
আদিল রশিদ ১০-০-৪৩-৪ (ও-২)।
ইংল্যান্ড ইনিংস :
জেমস ভিন্স এলবিডব্লু ব নাসির ৩২
স্যাম বিলিংস ক কায়েস ব মোসাদ্দেক ৬২
বেন ডাকেট ক মুশফিক ব শফিউল ইসলাম ৬৩
বেয়ারস্টো বোল্ড ব শফিউল ইসলাম ১৫
জস বাটলার বোল্ড ব মাশরাফি ২৫
বেন স্টোকস অপরাজিত ৪৭
মঈন আলী ক মাহমুদুল্লাহ ব মাশরাফি ১
ক্রিস ওকস অপরাজিত ২৭
অতিরিক্ত : (ও-৬) ৬
মোট (৪৭.৫ ওভার, ৬ উইকেট) রানÑ ২৭৮
উইকেট পতন : ১/৬৩, ২/১২৭, ৩/১৭২, ৪/১৭৯, ৫/২২৭, ৬/২৩৬।
বোলিং :
মাশরাফি ১০-১-৫১-২
শফিউল ৯.৫ -০-৬১-২(ও-৩),
সাকিব ৮-০-৪৫-০(ও-১),
তাসকিন ৯-০-৪৬-০(ও-১)
নাসির ৭-০-৫৩-১(ও-১),
মোসাদ্দেক ৪-০-২২-১
ফল : ইংল্যান্ড ৪ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা : আদিল রশিদ (ইংল্যান্ড)।
সিরিজ সেরা : বেন স্টোকস (ইংল্যান্ড)।
সিরিজ : তিন ম্যাচ সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতল ইংল্যান্ড।