22-10-16-al-conference_pm_sohrawardi-uddan-29

আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলন উদ্বোধন করে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দলের নেতা-কর্মীদের সক্রিয়তা প্রত্যাশা করেছেন শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে নির্বাচিত সব জনপ্রতিনিধিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, নিজ নিজ এলাকায় দরিদ্র, গৃহহারা, হতদরিদ্র, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী তালিকা বানান। তাঁদের জন্য আমরা বিনা পয়সায় ঘর তৈরি করে দেব। তাঁরা যেন বেঁচে থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে দেব।

শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে সভাপতির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। জাতীয় সংগীত ও দলীয় সংগীতের পর শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সকাল ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। ভোর থেকে শুরু করে দুপুর পর্যন্ত সম্মেলনস্থলে নেতা-কর্মীদের প্রবেশ করতে দেখা যায়।২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে কাউন্সিলর, ডেলিগেট ও ওয়ার্ড থেকে শুরু করে সাংসদ পর্যন্ত সব পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দরিদ্র মানুষের তালিকা করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আমরা দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাই। নিজ নিজ এলাকায় কতজন দরিদ্র মানুষ আছে, গৃহহারা মানুষ আছে। যাঁর ঘর নাই, বাড়ি নাই-ঠিকানা নাই। নিঃস্ব-রিক্ত মানুষ আছে। কারা হতদরিদ্র, বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী আছেন, আপনারা তাঁদের তালিকা বানান। তাঁদের জন্য আমরা বিনা পয়সায় ঘর তৈরি করে দেব। তাঁরা যেন বেঁচে থাকতে পারেন, তার ব্যবস্থা করে দেব। কারণ, তাঁরা আমাদের নাগরিক, এটা আমাদের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগ জনগণের সংগঠন। কাজেই জনগণের কল্যাণ করাই আমাদের দায়িত্ব।

শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা যদি এই কাজটা ভালোমতো করতে পারি, তাহলে এই বাংলাদেশে কোনো দরিদ্র থাকবে না। দারিদ্র্যের হার ৯৭ ভাগ ছিল। আমরা ২২ দশমিক ৪ ভাগে নামিয়ে এনেছি। হতদরিদ্রের হার ১২ ভাগে নামিয়ে এনেছি। বাংলাদেশে দরিদ্র বলে কিছু থাকবে না, এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা।বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবে। সন্ত্রাসকে কখনো আমরা প্রশ্রয় দেব না। এর বিরুদ্ধে সব রকমের ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং নিয়ে যাব। বাংলাদেশের মাটি, ভূখন্ড কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। প্রতিবেশী দেশে সন্ত্রাসী কর্মকা- চালানোর জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আমাদের ভূখন্ড কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এটা আমার সিদ্ধান্ত। দক্ষিণ এশিয়া হবে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন।

সম্মেলনে ২০৪১ সালের বাংলাদেশ কেমন হবে, তারও একটা চিত্র দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি হবে ৮ থেকে ১০ ভাগ। মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। এই আয় আরও বৃদ্ধি করব যেন এই দেশের মানুষ আর দরিদ্র না হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। দারিদ্র্যের হার হবে শূন্যের কোঠায় এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হবে। সবাই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। কোনো অন্ধকার থাকবে না। প্রতিটি ঘরে আলো জ্বালাব। অর্থাৎ এখন ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। ৭৮ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। ইনশাআল্লাহ তখন শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে।২০৪১ সালের বাংলাদেশ বিমান পরিবহনের একটি ‘হাব’ (কেন্দ্রবিন্দু) হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানবন্দর আমরা এমনভাবে উন্নত করব যেন সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি হয়। প্রাচ্যের মানুষ যখন পাশ্চাত্যে যাবে আবার পাশ্চাত্যের মানুষ যখন প্রাচ্যে যাবে, তখন বাংলাদেশই হবে হাব। এটাই হবে সেতুবন্ধন। সব ধরনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ উন্নত করব।বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের এই নীতির আলোকে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। তিনি আরও বলেন, আমাদের সিদ্ধান্তÑসন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের স্থান বাংলাদেশে হবে না। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে একটি শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব। স্বাধীনতার সুফল বাংলার প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে আমরা পৌঁছে দেব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব। এই বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ। যে স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছেন, তা পূরণ করব।

বেলা ১টা ২০ মিনিটে শেখ হাসিনা ভাষণ দেওয়া শুরু করেন। শুরুতেই তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়াও অনুষ্ঠানে আসা অন্য দলগুলোর অতিথি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দলের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের হাতে নিহত সবার কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ যখন স্বনির্ভরতা অর্জনের দিকে যাচ্ছিল, তখনই সেই ভয়াবহ হামলা হয়। ওই দিন আমার পরিবারের ১৮ সদস্য নিহত হয়েছে। এভাবে বেঁচে থাকা যে কী কষ্টের, তা যাদের স্বজন হারিয়েছে, শুধু তারাই বুঝতে পারে।’ শেখ হাসিনা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ধরে রেখেছেন এর তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তাঁরাই দলের প্রাণ।ঐতিহ্যবাহী দলটির সম্মেলনকে ঘিরে আজ কয়েক দিন ধরেই এই উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীজুড়ে। নগরের বিভিন্ন জায়গায় রং-বেরঙের ব্যানার ও ফেস্টুনে সাজানো হয়েছে। অনেক জায়গায় তৈরি করা হয়েছে ব্যানার। এ সম্মেলন উপলক্ষে পুরো নগরে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। সম্মেলন উপলক্ষে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

সিকি শতকের মধ্েয সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সরকার কী কী করছে, শনিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দলের সম্মেলনে তা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।ক্ষমতাসীন দলটির এবারের সম্মেলনের স্লোগানই ছিল- ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।আওয়াম বা জনগণের দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে তুলে ধরে তা নেতা-কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “জনগণের দায়িত্ব আমাদের।

২০৪১ সালের মধ্েয দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার যে কাজ করছে, তা এগিয়ে নিতে নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আর দারিদ্র্য থাকবে না। দরিদ্র্য বলে আর কিছু বাংলাদেশে থাকবে না।তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা, সংসদ সদস্যসহ দলের নেতা-কর্মীদের হতদরিদ্রদের তালিকা করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, স্ব স্ব এলাকায় কতজন দরিদ্র্য, গৃহহারা মানুষ আছে, যাদের ধন নাই, বাড়ি নাই, নিঃস্ব-রিক্ত, প্রতিবন্ধী ও বয়োবৃদ্ধ আছে, তাদের তালিকা করেন, আমরা তাদের বাড়ি করে দেব।

দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত দেশ। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ কোনো বৈষম্য থাকবে না। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবস্থা নেব। শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে।২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রতিটি সেক্টরে যেন উন্নয়ন হয় সেজন্য ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। মাইক্রো ক্রেডিটের পরিবর্তে মাইক্রো সেভিং করে দারিদ্র্য দূর করতে সফল হচ্ছি।”সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ্য নিয়ে ২০তম সম্মেলন করছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দলটি। সকালে বর্ণাঢ্য আয়োজনে সম্মেলন উদ্বোধন করেন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা।বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের ছয় বছর পর ৩৫ বছর আগে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে টানা দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনা।

বিদেশে থেকে স্বজন হারানোর বেদনা তুলে ধরার সঙ্গে তার দেশে ফেরার আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের আত্মত্যাগও উঠে আসে বঙ্গবন্ধুকন্যার বক্তব্যে।আওয়ামী লীগের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সে সময় যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা আমাকে দেশে আসার অনুমতি দেয়নি। কিন্তু তারা শত চেষ্টা করেও পারেনি। আওয়ামী লীগ আমাকে সভাপতি করে দেশে নিয়ে এসেছিল।

আমাদের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা আত্মত্যাগ, শত আঘাত ও শত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে এই সংগঠনকে ধরে রেখেছে।আওয়ামী লীগ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশে সকল অর্জন এনে দিয়েছে। আজকের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিদেশি অতিথিদের সামনে বক্তব্েয শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তার সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টিও তুলে ধরেন।আমাদের অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার। জিরো টলারেন্স এগেইনেস্ট টেররিজম। আমরা জঙ্গিবাদকে কখনোই প্রশ্রয় দেব না। এ দেশের ভূ-খ- কেউ কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহার করতে পারবে না।

সভাপতির ভাষণের পর সম্মেলন মুলতবি করেন শেখ হাসিনা। দুপুরে খাবারের বিরতির পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে রুদ্ধদ্বার কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়, যেখানে দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও নতুন নেতৃত্ব গঠিত হবে।গত ৩৫ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসা শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেন, অবসরে যাওয়ার সুযোগ পেলে তিনি খুশি হবেন। তবে দলীয় নেতারা বলে আসছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।আলোচনা চলছে সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে। সভাপতির পর সাংগঠনিক দিক দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে গত দুই বারের সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামই থাকছেন, না নতুন কোনো মুখ দেখা যাবে- সে প্রশ্ন ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও।