টাকা নিয়ে বসে আছে ব্যাংক। প্রতিদিনই বাড়ছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। ধারাবাহিকভাবে কমছে সুদহারও। সবই আছে, নেই শুধু ঋণ নেয়ার মতো উদ্যোক্তা। ফলে ব্যাংকে বাড়ছে অলস টাকা। মুখ থুবড়ে পড়েছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ পরিস্থিতি।গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ অবকাঠামো অসুবিধা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সুশাসনের অভাব ও যথাযথ ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ না থাকায় সুদহার কমার পরও বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সংশি।লষ্টরা। যে কারণে একদিকে ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত তারল্য বা অলস টাকা বাড়ছে। অন্যদিকে ধারাবাহিকভাবে কমেছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি।

বিনিয়োগ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ. বি. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বর্তমান বিনিয়োগের প্রধান সমস্যা অবকাঠামো অসুবিধা ও সুশাসনের অভাব। এছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। আর এসব কারণে উদ্যোক্তারা নতুন করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করতে আগ্রহ পাচ্ছেন না। ফলে সুদহার কমলেও ঋণের চাহিদা বাড়েনি। আর সাম্প্রতিক সময়ে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে বেড়েছে এটা ঠিক, তবে এখনও তা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে জানান তিনি।সংকট থেকে উত্তোরণের বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগে স্থবিরতা কাটাতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য সবার আগে অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এছাড়াও রাজনৈতিক যে অনিশ্চয়তা আছে তার সূরাহা করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের মধ্যকার সুদহারের ব্যবধান (স্প্রেড) বর্তমানে ৫ শতাংশের পয়েন্টের নিচে অবস্থান করছে। সর্বশেষ চলতি বছরের অক্টোবরের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭০ শতাংশে। এছাড়াও গত পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিক কমছে ব্যাংকের ঋণ ও আমানতের সুদহার।

অক্টোবর শেষে ব্যাংকগুলোর গড় ঋণের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশে। আগের বছর ২০১৫ সালে একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে ছিল ১২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ২০১৩ সালে ছিল ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ঋণের সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ব্যাংকগুলোতে গড় ঋণের সুদহার কমেছে প্রায় ৪ শতাংশ। এছাড়াও অনেক ব্যাংক বর্তমানে ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছে। তারপরও ঋণ গ্রহণের উদ্যোক্তা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।এ বিষয়ে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ কামাল খান চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ব্যাংক ঋণের সুদহার অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও উদ্যোক্তারা ঋণ নিচ্ছে না। এর প্রধান কারণ অবকাঠামোগত সমস্যা। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট। আর এর মধ্যে গ্যাস সংকটই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।তিনি বলেন, উদ্যোক্তারা নতুন কোনো শিল্প কারখানা স্থাপন করলেও গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। ফলে তাদের বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে করে অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ছে কারখানাগুলোতে। ফলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে নতুন উদ্যোক্তারা। যার করণে সুদহার কমানোর পরও ঋণ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। তাই অবকাঠামো সমস্যা না কাটলে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দিলেও বিনিয়োগে মন্দা দূর হবে না। তিনি আরোও বলেন, উদ্যোক্তারা এখন ব্যাংকের পেছনে ছুটছেন না, ব্যাংক ছুটছে উদ্যোক্তার পেছনে। তারপরও কোনো সুফল আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রথম তিন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। গত অর্থবছরের এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। গত জুনে বেসরকারি খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ছয় লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ছয় লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার কয়েক বছর ধরে কমছে। বেসরকারি বিনিয়োগের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণেই এমনটি হচ্ছে।তথ্য মতে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে ৬ দশমিক ০২ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৫-১৬ অর্থবছর তা আরো কমে দাঁড়ায় ৫ দশমকি ৫৩ শতাংশে। এছাড়াও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে ২১ দশমিক ৭৮ শতাংশে দাঁড়ায়।ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই এর সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমেদ বলেন, চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় শিল্প-কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে যেতে পারছে না। এছাড়াও গ্যাস সংযোগ পাবে বলে অনেক শিল্প-কারখানার মালিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আমদানি করেছে। গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় সেসব যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকের অর্থায়নও ঝুঁকিতে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে একজন উদ্যোক্তা নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে শিল্প কারখারা করবে।সুদহার কমেছে এটা সন্তোষজনক হলেও সরকার থেকে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা যোগানের নিশ্চয়তা না পেলে চলমান বিনিয়োগ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলে জানান মাতলুব আহমেদ।

এদিকে নিয়মানুযায়ী দেশের ব্যাংকগুলোকে নগদ ও বিধিবদ্ধ (সিআরআর ও এসএলআর) বিভিন্ন উপকরণে অর্থ সংরক্ষণ করতে হয়। সব মিলিয়ে এ জন্য রাখতে হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য রাখতে হয় আরও কিছু নগদ অর্থ। অথচ বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে তারল্য রয়েছে তিন লাখ কোটি টাকার উপরে। অর্থাৎ নগদ অর্থ বেশি আছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা। বিনিয়োগ স্থবিরতায় অলস টাকা বাড়ছে বলছেন ব্যাংকাররা।