জঙ্গি,সন্ত্রাস দমন, অপরাধীর ছবি এবং তথ্য মুহূর্তের ধরা পড়বে প্রযুক্তিতে। বিশ্বায়নের যুগে আরো উচ্চপ্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ পুলিশ। এফবিআই বা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড যে ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত করে থাকে, সে ধরনের আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তদন্ত কার্যক্রম চালাবে পুলিশ। অপরাধী যে কৌশলেই যোগাযোগ করুক না কেন তা গোয়েন্দা রাডারে ধরা পড়বেই। অ্যাপস কিংবা অধিকতর প্রটেক্টেড বার্তা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হবেন গোয়েন্দারা।ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা বদলে ফেলে পুলিশ বাহিনীকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার জাতীয় পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন করে এই আহ্বান জানান দেশের সরকারপ্রধান।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদসদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পুলিশের সেবা আরো জনবান্ধব করতে হবে।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃত করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা তার ভাষণে যে কথা বলেছিলেন, ‘এই দেশ স্বাধীন দেশ। আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমাদের পুলিশ বাহিনী স্বাধীন দেশের পুলিশ বাহিনী। কাজেই তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে দায়িত্ববান থাকতে হবে, জনসেবা করার মানসিকতা নিয়ে।

পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশকিছু প্রযুক্তি সংযোগ করার বিষয়ে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। আধুনিক বিশ্ব যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে পুলিশের বহরে তা যোগ করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন সরকার প্রধান। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। সংস্থাটি কোনো ধরনের সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়াই নিরাপত্তা, তদন্ত, প্রমাণ সংগ্রহ এবং অনুসন্ধানের স্বার্থে যে কোনো কম্পিউটার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ ও অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম হ্যাক করতে পারে। অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য এফবিআই চালু করেছে মুখম-ল শনাক্তকরণ প্রযুক্তি। নিরাপত্তার স্বার্থে যে কারো ওয়েবক্যাম চালু করার সক্ষমতা আছে তাদের। বাংলাদেশ পুলিশও এ ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়টি এবারের পুলিশ সপ্তাহে আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়বস্তু ছিল।

এছাড়া পুলিশ সদস্যদের জন্য আরো ব্যারাক নির্মাণের দাবি তোলা হয়। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের আদলে ব্যারাক নির্মাণের জন্য পুলিশের করা আবেদন বিবেচনায় রাখা হয়েছে। বছরে একজন পুলিশ সদস্য দুটি করে পোশাক পেয়ে থাকেন। আর এখন থেকে তিনটি করে পোশাক পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুলিশ কর্মকর্তারা এমন দাবি করলে তিনি সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। নিয়োগের ক্ষেত্রে এসআই (উপ-পরিদর্শক) পদে পুলিশ পরিবারের কোটা দাবি করা হলে সেটিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জঙ্গি এবং সন্ত্রাস দমনে আরো আধুনিক বাহিনীর রূপ দিতে প্রযুক্তিগত যা যা প্রয়োজন এসব সরঞ্জাম পুলিশের বহরে যোগ করতে যথাযথ নির্দেশনা দেন সরকার প্রধান। আভিযানিক এবং গোয়েন্দা অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ এখনো পিছিয়ে আছে। উন্নত দেশের তুলনায় ২০ ভাগ প্রযুক্তিও নেই। পুলিশের আধুনিক যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র, ইকুইপমেন্ট, পরিচ্ছন্ন কর্মক্ষেত্র এবং উন্নততর প্রশিক্ষণ এসব কিছুই প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হয়েছে। উন্নত দেশের তুলনায় এখন পর্যন্ত এক-চতুর্থাংশও পুলিশের নেই। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের কথা মাথায় রেখে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে।এবারের পুলিশ সপ্তাহের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সব স্তরের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণসভা। দীর্ঘ ছয় ঘণ্টাব্যাপী তিনি রাজারবাগে অবস্থান করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সদস্যের সুখ দুঃখের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। পুলিশ সদস্যরা পুলিশিংয়ের গুণগত মান ঠিক রাখার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রতিটি পুলিশ সদস্য নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত ৭০ ভাগ সময় বেশি ডিউটি করছেন। দৈনিক নূন্যতম ৮ ঘণ্টা ডিউটির জায়গায় প্রত্যেক সদস্যকে আনুমানিক ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়।মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন এমন দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা হলেন ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন। তার মতে, কর্মক্ষেত্রে লাগাতার ১০ ঘণ্টার বেশি নিয়োজিত থাকলে কোনো দেশের পুলিশের পক্ষেই মানসম্মত সেবা দেয়া সম্ভব নয়। তবে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা ওভারটাইম হিসেবে কাউন্ট করে অনেক দেশই সেবার মান কিছুটা বাড়াতে সক্ষম হলেও সাপ্তাহিক হিসেবে একটি নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার বেশি ডিউটি করতে দেয়া হয় না। কোনো পুলিশ সদস্য নিজ থেকে চাইলেও তাকে দেয়া হয় না। তিনি বলেন, গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৬-১৮ ঘণ্টা ডিউটি আর মাসে নূন্যতম ১৫/১৬টি নাইট ডিউটি করতে হয় অধিকাংশ পুলিশ সদস্যকে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন থেকে অধিকাংশ সময় বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়।জানা গেছে, এবারের পুলিশ সপ্তাহে এসব বিষয় আলোচনায় স্থান পেয়েছে। পুলিশ কনস্টেবল থেকে পুলিশ প্রধান পর্যন্ত সব পর্যায়ের সদস্যরা সরকার প্রধানের কাছে তাদের দাবি ও সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। সরকার প্রধান সব বিষয় মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন।দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, এবারের পুলিশ সপ্তাহে সরকার প্রধানের নির্দেশনার পর শিগগিরই পুলিশের বহরে প্রযুক্তি সমারোহ ঘটবে। বিশেষ করে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর কয়েকটি প্রযুক্তির অভাববোধ হয়েছিল। কিন্তু দেশি এবং বিদেশি নানা প্রশিক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক কর্মকর্তা প্রযুক্তিনির্ভর তদন্তে সহায়তা করেন। এর ফলে জঙ্গিদের অনেক মুছে ফেলা তথ্য বের করা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের যুগে অপরাধীরা বিভিন্ন ধরনের অ্যাপসে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে পুরোপুরি এসব অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করার মতো প্রযুক্তি নেই। শুধু ক্ষেত্রবিশেষে কিছু তথ্য উদ্ধার করা যায়। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে অ্যাপসের তথ্য রেকর্ড করা সম্ভব হবে।

পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ডাটা অ্যান্ড অ্যাপস ক্যাচার, ব্যাকপ্যাক ক্যাচার ও হার্ডওয়ার ফরেনসিকের মতো তিনটি ডিভাইস আনা হচ্ছে। এর মধ্যে ডাটা অ্যান্ড অ্যাপস ক্যাচার প্রযুক্তির মধ্যে ভাইবার, ইমো, হোয়াটস অ্যাপসসহ বিশ্বের যে কোনো অ্যাপসের তথ্য রেকর্ড করা সম্ভব। একই সঙ্গে এ ডিভাইসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মুছে ফেলা তথ্য উদ্ধার করা যাবে।এছাড়া ব্যাকপ্যাক ক্যাচার যে কোনো আসামির সম্ভাব্য অবস্থান বলে দেবে। এ ডিভাইসের মাধ্যমে আসামির ছবি সংযুক্ত করলে তার পিনপয়েন্ট অবস্থান জানা সম্ভব হবে। পাশাপাশি অপরাধী তার ব্যবহƒত মোবাইল বন্ধ রাখলেও তাকে ধরার ক্ষেত্রে বিশেষ সংকেত পাওয়া যাবে। এমনকি হারিয়ে যাওয়া ল্যাপটপও উদ্ধার করা যাবে।হার্ডওয়ার ফরেনসিক পদ্ধতিতে অধিকতর পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধীর আইটিসংক্রান্ত যোগসূত্র বের করা সম্ভব। ল্যাপটপ, কম্পিউটার বা যে কোনো অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার করা তথ্য মুছে ফেললে তা উদ্ধার সম্ভব। এ ডিভাইস অতীতের সব মুছে ফেলা হিস্টরি সচল করে দেবে।
জানতে চাইলে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে উচ্চপ্রযুক্তির যুগে পুলিশের প্রবেশ এখন সময়ের দাবি। জঙ্গি-সন্ত্রাস দমনে পুলিশ সবসময় পেশাদার এবং দক্ষতা দেখিয়ে আসছে। যেহেতু বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, তাই প্রযুক্তির বিকল্প নেই। শান্তিময় ও নিরাপদ সমাজ গঠনে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে আরো জোরদার করার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রতিটি পুলিশ সদস্যকে অসহায় ও বিপন্ন মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ চিত্তে সেবার হাত প্রসারিত করতে হবে।এবারের পুলিশ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য ‘জঙ্গি মাদকের প্রতিকার, বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার।রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে গতকাল সোমবার পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনে ১৩২ জনকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) এবং রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) পারিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য ২৬ জনকে ২০১৬ সালের বিপিএম এবং ৪১ জনকে পিপিএম দেয়া হয়। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামূলক আচরণের জন্য ২৪ জন বিপিএম (সেবা) এবং ৪১ জন পিপিএম (সেবা) পেয়েছেন এবার।২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশের ২১ সদস্য জীবন দিয়েছেন।