কুয়াকাটা সৈকতের শুন্যপয়েন্টর দুই দিকে বিশাল সাগরের এক শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে জেগে উঠেছে প্রায় অর্ধশত ডুবো কিংবা জেগে ওঠা চর। দুই থেকে দশ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে জেগে ওঠা একেকটি চর এখন যেন আরেক বাংলাদেশের অবস্থানকে জানান দিচ্ছে। এসব চরে এখনই জেলেরা ট্রলার কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় অবস্থান করে। থাকে শীতের পুরো মৌসুম। জেগে ওঠা চরে জেলেরা অবস্থান করলেও ডুবো চরে বাঁশ কিংবা খুটা পুতে জাল পেতে ধরছে। আবার এসব চরে নজর পড়েছে ভূমিদস্যু কিংবা জোতদারদের। এসব চরকে আগেভাগেই কাগজপত্রে বন্দোবস্ত নেয়ার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে দখলবাজচক্র। এসব চরের কারণে সাগরে নৌ-চলাচল অনেকটা ঝুকিপুর্ণ হয়ে পড়ছে। জেলেরা জানান, এসব চরের কারণে সাগরের এই অঞ্চলে ইলিশসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ আহরন করতে সমস্যা হচ্ছে। এমনকি ইলিশের বিচরণক্ষেত্রও পবির্তন হওয়ার শঙ্কা করছেন জেলেরা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুপার সাইক্লোন সিডরের পর থেকে সাগরে এভাবে চর পড়তে থাকে। প্রথমত এসব ডুবোচর ছিল। ভাঁটার সময় হাটুজল থাকত চরগুলোতে। যা এখন জোয়ারের সময়ও জেগে থাকছে। তুফাইন্যার বনাঞ্চল ঘেরা চরের দুই কিমি দক্ষিণে অন্তত ছোট-বড় সাতটি চর জেগে উঠেছে। এসব চরে এখন জেলেরা শীত মৌসুমে নৌকা কিংবা ট্রলার বেধে অবস্থান করে। এ চরের কারণে এখন নৌযান চলাচল করতে হয় অন্তত ৩০ কিলোমিটার গভীর সাগরের মধ্য দিয়ে। এভাবে চর হেয়ার, চরকাশেম, সোনার চর, কাউয়ারচর, গঙ্গামতির চর, কুয়াকাটাসহ রামনাবাদ মোহনা, আন্ধারমানিক মোহনা থেকে সাগর অভ্যন্তরে অসংখ্য ছোট-বড় চর জেগে উঠেছে। এসব চর জেগে ওঠায় বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন মাছ ধরার ট্রলার চলাচল পর্যন্ত ঝুকিপুর্ণ হয়ে গেছে। সমুদ্রপথ নৌ চলাচলও চরম ঝুকির কবলে পড়েছে। গভীর সমুদ্রের কোথাও নির্বিঘেœ কোন ধরণের নৌ যান চলাচল করতে পারে না। বিশেষ করে ভাটার সময় স্পিডবোট পর্যন্ত নির্বিঘেœ চালানো যায় না। জেলে সমিতির নেতা শেখ নিজামউদ্দিন জানান, আমরা খুটা জেলে। সাগরের অগভীর এলাকায় মাছ ধরেন। তাও চর জেগেছে। সিডরের পরে এভাবে সাগরের মাঝে ছোট-বড় অসংখ্য চার জাগতে শুরু হয়।

চরের কারণে ২০০৯ সালে কুয়াকাটা এবং তৎসংলগ্ন সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা জিও কাইনেটিক্স সুষ্ঠুভাবে তাদের অনুসন্ধান কাজ পরিচালিত করতে পারেনি। এমনকি পূর্ব পরিকল্পিত ম্যাপ থেকে একটি সাইসমিক লাইন তাদের বাদ দিতে হয়েছে। যা পরবর্তিতে স্থানান্তর করে নতুন সাইসমিক লাইনে সম্পন্ন করতে হয়। ওই কোম্পানির পাবলিক রিলেশন অফিসার অনুজ চৌধুরী বাবু জনকন্ঠকে জানান, কূল থেকে প্রায় ১৫/১৬ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। যে কারণে তাদের স্পিডবোট চলাচলে মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তিনি ধারণা দেন, কুয়াকাটা সৈকতের পশ্চিম থেকে শুরু করে ১৫-২০কিলোমিটার গভীর সমুদ্র পর্যন্ত পূব দিকের প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকা জুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। জোয়ারের সময় হাটু কিংবা কোমর সমান পানিতে ডুবে থাকে চরগুলো। কিন্তু ভাটায় পুরো ল্যান্ড এলাকা জেগে ওঠে। জেলেরা পায়ে হেটে চলাচল করছে। কুয়াকাটার উপকূলীয় জেলে সমিতির সভাপতি জনি আলমগীর (৩৫) জানান, কুয়াকাটা সৈকত থেকে ১০ কিলোমিটার সাগর গভীরে অসংখ্য বিরাট বিরাট চর জেগে উঠেছে। যেখানে জোয়ারে ৭/৮ ফুট পানি থাকলেও ভাটার সময় মাত্র ৩/৪ফুট থাকে। ট্রলার চালাতে হয় ধীরে ধীরে। তিনি জানান, অবস্থা এমন হয়েছে যে সাগর থেকে মাছ ধরে আন্ধার মানিক মোহনায় ঢুকতে গেলে এখন সমস্যা হয়। সাগর থেকে প্রায় পশ্চিম দিকে ৪/৫কিলোমিটার ঘুরে ফাতড়ার বনের কিনার থেকে থেকে বোট চালিয়ে মহীপুর আসতে হয়। এদেরও দাবি, সিডর আইলার পরে সাগরের মধ্যে বেশি বেশি চর জেগে উঠেছে। যেন গতি প্রকৃতি পর্যন্ত পাল্টে গেছে।পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^ বিদ্যালয়ের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ডীন প্রফেসর আ.ক.ম মোস্তফা জামান জানান, জেলেদের ধারনা সঠিক। কারন সিডরে ঝড়ের মুভমেন্টে ¯্রােতের সৃষ্টি হয়ে পলি জমেছে। ওই পলির সঙ্গে ভেসে আসা পলি জমে ক্রমশ চর পড়ছে। যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। জনাব জামান আরও জানান, কুয়াকাটার ৩০-৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিশাল এলাকাজুড়ে ক্রমশ চর পড়ছে তা স্যাটেলাইটের বদৌলতে বোঝা যাচ্ছে। গঙ্গা অববাহিকার কারনে ক্রমাগতভাবে দক্ষিণে চরের বিস্তৃতি ঘটতে থাকবে বলেও এ বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেন।

মহীপুর আলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গাজী ফজলুর রহমান জানান, সমুদ্র বক্ষে এতো বেশি চর জেগেছে যে বর্ষার সময় তাড়াতাড়ি কিনারে আসা যায় না। তিনি বলেন,‘এখন ভাটার সময় সাগর থেকে মহীপুরে আসতেই সমস্যা হয়। তারপর মাছ ধরে কিনারে ফিরতে সময় অনেক বেশি লাগে । তিনি আরও জানান, যে আগে মহীপুর আলীপুর থেকে বোট ছেড়ে ৪/৫ ঘন্টা সাগরে চালালে ৫ বাম পানিতে (১৫হাত গভীর) জাল ধরা যেত। আর এখন ১০/১২ ঘন্টা বোট চালানোর পরেও ওই পরিমান গভীর সাগরে পৌছানো যায় না। তবে সাগর মোহনার বিভিন্ন প্রবেশদ্বার খনন করা জরুরী বলে মনে করছেন জেলেরা। কারণ ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সময় কুয়াকাটা সংলগ্ন সাগর বক্ষে মাছ শিকার করা জেলেদের নিরাপদে দ্রুত আশ্রয় নেয়ার জন্য উপকূলের আন্ধার মানিক মোহনা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই । জেলেদের দাবি সাগরে যেভাবে চর জাগতে শুরু করেছে তাতে ভবিষ্যতে ইলিশ আহরণের ক্ষেত্র পর্যন্ত পাল্টে যাওয়ার শঙ্কা তাদের।