অপারেশন টোয়াইলাইট সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। রাত আটটায় সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টমেন্টে অনুষ্ঠিত প্রেসবিফ্রিংয়ে এই অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন সেনা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান । তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশাতেই সেনাবাহিনী এই অভিযানে অংশ নেয়। সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকায় আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর অভিযান প্রায় শেষ। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বাকি। এখন ভবনটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাহিনীটি। তবে মঙ্গলবার বিভিন্ন সময় আতিয়া মহল থেকে সাত আটটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এস এম রোকনউদ্দিন সন্ধ্যা পৌনে ছয়টার দিকে বলেন, পুলিশ এখন আতিয়া মহল ভবনটি বুঝে নিয়েছে। দুই জঙ্গির লাশ এখনও ভেতরে রয়েছে। তাদের গায়ে সুইসাইড ভেস্ট থাকায় সরানো হয়নি। পুলিশ পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।সকালে আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দলের অভিযান চালায়। সেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওই ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বিস্ফোরক দ্রব্য শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করা হয় বলে সেনাবাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র এ তথ্য জানায়। সূত্রটি জানায়, আতিয়া মহলের যেখানে-সেখানে অবিস্ফোরিত অবস্থায় হাতে তৈরি গ্রেনেড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এ ধরনের গ্রেনেড খুব বিপজ্জনক। বিশেষ করে যদি পিন খোলা অবস্থায় কোনো গ্রেনেড পড়ে থাকে, তাহলে যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেগুলো শনাক্ত ও উদ্ধার করা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।সকাল থেকে আতিয়া মহলে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দলের অভিযান চলে। বেলা একটার দিকে চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বিকেল চারটা ৪০ মিনিট ও পাঁচটার দিকে আরও দুটি বিস্ফোরণ শোনা যায়। এ সময় ধোয়া দেখা গেছে।আতিয়া মহলের আশপাশের এলাকায় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা আজও রয়েছে। আতিয়া মহল ঘিরে তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে সাধারণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কে চলাচল নিয়ন্ত্রিত থাকবে। গণমাধ্যমকর্মীরাও নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করছেন।

সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সেনা গোয়েন্দা পরিদপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, আতিয়া মহলে আর কোনো জঙ্গি জীবিত নেই। সবাই অভিযানে নিহত হয়েছে। সেখান থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষের মৃতদেহ বের করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও দুটি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে, যাদের শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট (আত্মঘাতী হামলার জন্য বিস্ফোরকভর্তি বন্ধনী) বাঁধা। ব্রিফিংয়ে আরও জানানো হয়, আতিয়া মহলের ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলেও সেখানে প্রচুর বিস্ফোরক বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে রয়েছে। তাই অভিযান শেষ হচ্ছে না।

তবে আজ সেনাবাহিনী জানায়, আতিয়া মহল থেকে চারটি মৃতদেহ বের করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, নিহত চারজনের মধ্যে একজন মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসা। তাঁরা জানান, মুসা যে ছবি দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন, সেই ছবির সঙ্গে পুলিশের কাছে থাকা ছবির মিল দেখে তাঁরা পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন।

আতিয়া মহল নামের পাঁচতলা এই বাড়ি গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় ঘিরে ফেলে পুলিশ। গত শুক্রবার ঢাকা থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াট গিয়ে অভিযানে অংশ নেয়। এরপর গত শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দল ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামে অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত এবং আরও ৪৪ জন আহত হন। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে শিববাড়ি পাঠানপাড়ার ওই ভবন ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সোয়াট এবং সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। শনিবার সকালে শুরু হয় চূড়ান্ত অভিযান।শুরুতে সোয়াট এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন স্প্রিং রেইন’। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে তারা পিছু হটে বলে সেনা কর্মকর্তারা জানান।

প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইমরুল হাসানের নেতৃত্বে সেনাঅভিযানের নাম বদলে হয় অপারেশন টোয়াইলাইট’।দক্ষিণ সুরমা উপজেলার শিববাড়ি এলাকা ঘিরে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সেনা অভিযান শুরুর পর ব্যাপক গোলাগুলির মধ্যে শনিবারই ওই ভবন থেকে ৭৮ জনকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।ওই অভিযানের মধ্যেই শনিবার সন্ধ্যায় আতিয়া মহল থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে এক জায়গায় দুই দফা বিস্ফোরণে দুই পুলিশ সদস্যসহ ছয়জন নিহত হন। রোববার বিকালে এক ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান জানান, ওই বাড়িতে অন্তত দুই জঙ্গি মারা পড়েছে এবং ভেতরে আরও জঙ্গি রয়েছে বলে তাদের ধারণা।তিনি বলেন, বাড়ির ভেতরে থাকা জঙ্গিদের কাছে ‘স্মল আর্মস’, এক্সপ্লোসিভ ও আইইডি আছে। তারা সবাই সুইসাইড ভেস্ট পরে আছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে তারা আইইডি পেতে রাখায় পুরো বাড়ি বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে অভিযানে সময় লাগছে। সোমবারও সকাল থেকে দফায় দফায় গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। এরই মধ্যে কমান্ডোরা আতিয়া মহলের দুই দিকের দেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এক পর্যায়ে ওই বাড়ি থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি তা নেভায়।

ওইদিন রাতে আবারও সংবাদ ব্রিফিংয়ে এসে জঙ্গি আস্তানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এবং ভেতরে চারটি লাশ পাওয়ার কথা জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল।তিনি বলেন, নিহত চার জঙ্গির মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। তাদের মধ্যে এক পুরুষ ও এক নারীর লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুটি লাশের শরীরে সুইসাইড ভেস্ট থাকায় সেগুলো সরানো হয়নি। ভেতরে অবস্থানরত সম্ভাব্য সব জঙ্গি নিহত হলেও তারা বাড়িটিতে ব্যাপক বিস্ফোরক মজুদ করে রাখায় সোমবার সন্ধ্যয় অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করেননি ব্রিগেডিয়ার ফখরুল।তিনি বলেন, দুঃসাহসিক অভিযানের জন্য আমরা সকলেই গর্বিত। আপনারও গর্ববোধ করতে পারেন। দেশবাসীর দোয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই খুব সুন্দর, সফলভাবে অভিযানটা চলেছে। সেনাবাহিনী আতিয়া মহলের দায়িত্ব পুলিশের হাতে বুঝিয়ে দেয়ার আগে মঙ্গলবার দুপুরে পরপর চারটি বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। ওই ভবনে জঙ্গিদের ফেলে রাখা বোমা নিষ্ক্রিয়করণের কাজ চলছে বলে সে সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়।ওই ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিস্ফোরক শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে একটি ড্রোনসহ বিভিন্ন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেনাবাহিনী।এদিকে দুপুরে দুই জঙ্গির লাশের ময়নাতদন্ত হয় ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সিলেটের জঙ্গিবাড়ি আতিয়া মহলে নিহত চার জঙ্গির মধ্যে একজন পুরুষের মৃত্যু হয়েছে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে, আর এক নারী নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে পুলিশের ধারণা। সেনাবাহিনী সোমবার ওই দুইজনের লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তরের পর মঙ্গলবার ওসমানী মেডিকেল কলেজ কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত হয়।

বাকি দুটি লাশ এখনও ওই জঙ্গি আস্তানার ভেতরে রয়েছে। গায়ে সুইসাইড ভেস্ট থাকায় সেগুলো এখনও সরানো হয়নি বলে মোগলাবাজার থানার ওসি খায়রুল ফজল জানিয়েছেন।দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার ওই বাড়িতে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ভবনটি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শনিবার সকালে সেখানে চূড়ান্ত অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনীর কমান্ডো দল। সোমবার রাতে ওই ভবন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার কথা জানিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, ভেতরে চার জঙ্গির লাশ পেয়েছেন তারা। সেনাবাহিনীর ওই প্রেস ব্রিফিংয়ের আগে সন্ধ্যা ৬টার পর আতিয়া মহলের সামনে লাশ দুটির সুরতহাল করেন দুই পুলিশ সদস্য। পরে সেগুলো মর্গে পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য।পুরুষের লাশটির সুরতহাল করেন মোগলাবাজার থানার এসআই মো. সোহেল রানা। আর একই থানার এসআই সুজন দত্ত নারীর লাশের সুরতহাল করেন।

সুরতহাল প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নিহত ওই পুরুষের দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি। গোলাকার মুখম-ল ছিল আগুনে পোড়া। মাথার সামান্য চুল ও মুখে কিছু দাড়ি ছিল।ওই ব্যক্তির পরনে ছিল কালো জামা, দুই পায়ে কালো জুতা। আর ডান পায়ে কালো প্যান্টের অংশ লেগে ছিল।লাশের বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত পুরোটাই ছিল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন। বাঁ পায়ের মাংস গোড়ালির টাকনু পর্যন্ত কাটা।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা লাশটি একজন জঙ্গি সন্ত্রাসীর লাশ বলিয়া প্রতিয়মান হয়। উক্ত জঙ্গি সন্ত্রাসী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য নিজে নিজে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটাইয়া মারা গিয়াছে বলিয়া অনুমান করা যাইতেছে।নিহত ওই নারীর দৈর্ঘ্য আনুমানিক চার ফুট বলে উল্লেখ করা হয়েছে সুরতহাল প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, তার মুখমন্ডল ছিল পোড়া, মাথায় সামান্য চুল দেখা গেছে।দুই হাত ও দুই পায়ের গিড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ দেহ পোড়া এবং বাইরে থেকে কঙ্কাল দৃশ্যমাণ। একটি পায়ে সামান্য মাংস আছে এবং পায়ের তালুর নিচে আনুমানিক দুই ইঞ্চি কাটা।এসআই সুজন দত্ত লিখেছেন, বুক ও পা দেখে প্রতীয়মান হয় যে লাশটি একজন নারীর।লাশটি একজন জঙ্গি সন্ত্রাসীর স্ত্রীর এবং গোপনীয়ভাবে জানা যায়, ওই নারী নিজেও একজন জঙ্গি সন্ত্রাসী দলের সদস্য। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য নিজের গায়ে নিজে আগুন লাগাইয়া মৃত্যুবরণ করিয়াছে বলিয়া অনুমান হয়, বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মর্জিনা বেগম ও কাউছার আলী নামে দুইজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে মাস তিনেক আগে নিচতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন।