রোববার বেলা সাড়ে ১১টা।রাজধানীর মিরপুর রোডে যাতায়াতকারী অগ্রদূত পরিবহনের একটি বাস আগারগাঁওয়ে থামালেন অভিযানে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনিব রহমান। বাসের মধ্যে ভাড়ার কোনো তালিকা না থাকায় এক হাজার টাকা জরিমানা করলেন। কেবল এ বাসটি নয়, এই পথে চলাচলকারী বিকল্প ও শেকড়ের কয়েকটি বাসেও ভাড়ার তালিকা পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও কয়েকটি বাসের বিরুদ্ধে।রাজধানীর আগারগাঁও, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার মোড়, শাহবাগ ও রমনা এলাকায় বাসে থাকা এবং অপেক্ষমাণ যাত্রীদের অভিযোগ, সিটিং সার্ভিস বন্ধ হলেও বাসগুলো ভাড়া কমায়নি। বরং লোকাল বাসের মতো যেখানে সেখানে যাত্রী তুলছে। আর সর্বনিম্ন সাত টাকা ভাড়া থাকলেও বাসের কর্মচারীরা অনেক ক্ষেত্রেই এর চেয়ে বেশি নেয় বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।অবশ্য অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়াসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে আজ রোববার রাজধানীর আসাদগেট, আগারগাঁও (আইডিবি ভবনের সামনে), শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে, রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে ও যাত্রাবাড়ীর চাংপাই রেস্তোরাঁর সামনে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছেন। অভিযানের কারণে সড়কে বাস কম ছিল। তবে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা পর্যন্ত গণপরিবহনে অভিযান চলবে।
অভিযানে কী কী অনিয়ম পাচ্ছেন জানতে চাইলে আগারগাঁওয়ে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুনিব রহমান বললেন, সকাল সাড়ে দশটা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত মোট ৩০টি মামলা করেছেন। এর মধ্যে ২৩টি বাসের বিরুদ্ধে। বাসগুলোর বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ যেমন করেছেন যাত্রীরা, তেমনি অনেক বাসে ভাড়ার তালিকা ছিল না।কয়েকটি বাসের ওপরে ক্যারিয়ার পাওয়া গেছে। আর বাম্পার না খোলায় সাতটা লেগুনাকে জরিমানা করা হয়। এসব ঘটনায় ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তবে কোনো বাসেরই গেট বন্ধ বা সিটিং পাওয়া যায়নি।তবে মিরপুর থেকে শাহবাগের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে যাতায়াতকারী সিনিয়র স্টাফ নার্স জেসমিন আরা অভিযোগ করলেন, অন্য দিনের চেয়ে আজ বাসে তিনি সমস্যা বোধ করছেন। কারণ, সিটিং না থাকায় সমানে যাত্রী তুলছে বাসগুলো। তিনি বলেন, যাত্রী পূরণ হয়ে গেলে বাসগুলো যেন আর যাত্রী না তোলে সেটিও দেখা দরকার। কিন্তু সেদিকে কেউ নজর দিচ্ছে না। এ কারণে নারীদের দুর্ভোগ আরও বাড়ল।

মৃন্ময় মিন্টু নামের এক যাত্রী অভিযোগ করেন, মিরপুর ১ থেকে শাহবাগের বাসভাড়া তালিকা অনুযায়ী ১৬ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু দিশারী পরিবহন এখনো ২৫ টাকা নিচ্ছে। এম আর আবির নামে এক যাত্রী অভিযোগ করেছেন, মিরপুর-১ থেকে হেমায়েতপুরের ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু নিচ্ছে ৩৫ টাকা। তা-ও যাত্রীদের দাঁড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে।প্রথম দিনের অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ দুপুরে বলেন, আমরা পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে অভিযানে ছিলাম। আমি নিজে দুটি জায়গায় ছিলাম। এটা ঠিক, কিছু বাসে ভাড়ার তালিকা ছিল না। কিছু বাসের বিরুদ্ধে বাড়তি ভাড়া নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিনের অনিয়ম তো এক দিনে বন্ধ হবে না। তবে আমরা প্রতিদিনই অভিযানে থাকব। এভাবে চললে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

৪ এপ্রিল ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে সিটিং সার্ভিস প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দেয়। এ ছাড়া যানবাহন থেকে অবৈধ সাইড অ্যাঙ্গেল খুলে ফেলা এবং সিটিং সার্ভিস বন্ধসহ পরিবহন খাতের সমস্যা সমাধানে করণীয় ঠিক করতে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও মালিক-শ্রমিক নেতারা শনিবার এলেনবাড়ীতে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়ে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয় রোববার থেকে। সড়ক পরিবহন সমিতি ৪ এপ্রিল আরও যেসব সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১৫ এপ্রিলের পর যাত্রীদের কাছ থেকে কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া যাবে না। ভাড়ার তালিকা বাসের ভেতর দৃশ্যমান স্থানে টাঙিয়ে রাখতে হবে। ছাদের ওপরে ক্যারিয়ার, সাইড অ্যাঙ্গেল ও ভেতরের অতিরিক্ত আসন খুলে ফেলতে হবে। প্রতিটি বাস ও মিনিবাসে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা আসন সংরক্ষণ করতে হবে। এক মাসের মধ্যে রংচটা, রংবিহীন, জরাজীর্ণ বাস মেরামত করে রাস্তায় নামাতে হবে। তবে অনেকেই এখনো সেগুলো মানছেন না।মোটরযান আইন অনুসারে, সিটিং সার্ভিস বলে কিছু নেই। চালকের আসনসহ মিনিবাসে ৩১টি আসন থাকবে। আর বিআরটিএ পরিবহন খাতের ২০টি বিষয়ে ব্যয়ের খাত বিশ্লেষণ করে বাস-মিনিবাসের ভাড়া নির্ধারণ করে। সর্বশেষ ব্যয় বিশ্লেষণে, প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ৮০ শতাংশ আসন পূর্ণ হয়ে চলাচল করবে। কিন্তু রাজধানীতে প্রায় সারা দিনই দাঁড়িয়ে যাত্রী যাতায়াত করে। যাত্রীরা সকাল ও বিকেলে অফিসযাত্রা ও ছুটির সময় দরজাতেও ঝুলে যাতায়াত করেন।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার দুপুরে বলেন, ‘বাস মালিক সমিতির নেতারা আমাদের কথা দিয়েছেন, এখন থেকে বাড়তি ভাড়া তাঁরা নেবেন না। সব বাসে ভাড়ার তালিকা থাকবে। আমরা অভিযানে এ বিষয়গুলো দেখছি। এ ছাড়া বাম্পার, ক্যারিয়ার আছে কি না, সেটাও দেখা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, নিয়মিত অভিযান চললে শৃঙ্খলা ফিরবে।

এদিকে, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরে না আসা পর্যন্ত ঢাকায় গণপরিবহনে অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড়ে বাম্পারসহ যানবাহনের অবৈধ সংযোজন অপসারণের অভিযানে গিয়ে মন্ত্রী সাংবাদিকদের একথা বলেন।ওবায়দুল কাদের বলেন, গণপরিবহনে দীর্ঘদিন ধরে বিশৃঙ্খলা চলছে; ভাড়ায় বিশৃঙ্খলা, চলাচলে বিশৃঙ্খলা। পয়সা দিয়ে গাড়িতে উঠে অনেকে বসতে পারে না, দাঁড়িয়ে থাকে এবং খুবই ওভার লোডিং হয়।ওভারলোডিং না হলে শৃঙ্খলা ফিরে আসলে সুফল পাবে। ডিসিপ্লিন মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট, ডিসিপ্লিন ফিরে আসলে এর সুফল জনগণই পাবে। যতদিন না শৃঙ্খলা ফিরে আসে ততদিন অভিযান চলবে।‘সিটিং সার্ভিস’ চালানোর নামে ঢাকায় বাসে অনিয়ম বন্ধে রোববার থেকে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), যাতে সায় দিযেছে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় ঘণ্টা পর সকাল সাড়ে ৯টায় সড়কমন্ত্রী সাত রাস্তা মোড়ে এসে পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহনে অবৈধভাবে সংযোজিত বাম্পার, এঙ্গেল ও হুক অপসারণ কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পরিবহনে বাম্পার-অ্যাঙ্গেল সমস্যা সৃষ্টি করছে, অ্যাক্সিডেন্টের কারণ সৃষ্টি করছে, সেটা মোটরযানের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা সৃষ্টি করছে। সারা বাংলাদেশে একই সাথে এ অভিযান পরিচালনা হচ্ছে।সড়ককমন্ত্রী বলেন, জনগণের জন্য নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে বিআরটিএ এ অভিযান শুরু করেছে। এতে আমাদের সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, মালিক ও শ্রমিকরা সহযোগিতা করছে।

শুধু পরিবহন মালিক-শ্রমিক নয় বিশৃঙ্খলার জন্য বিআরটিএকেও দায়ী করেন তিনি মন্ত্রী বলেন, বিআরটিএর মধ্যও সমস্যা, জনবলের অভাবসহ আরও কিছু সমস্যা আছে, এখানে সর্ষের মধ্যে ভুত ছিল। সব মিলে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বিআরটিএ নির্দিষ্ট আকৃতি পরিবর্তন করে মোটরযান চলাচলকে প্রধানত দায়ী করা হয়।অবৈধ বিপদজনক সংযুক্তিযুক্তসহ (বিশেষ করে বাস, মিনিবাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সামনে-পেছনে অননুমোদিত বাম্পার এবং দুপাশে অবৈধভাবে তিনকোনা লোহা/স্টিলের পাত ও ট্রাকের বডিতে চোখালো-ধারালো হুক ইত্যাদি) মোটরযানের বিরুদ্ধে রোববার থেকে অভিযান শুরু হয়েছে।