অতিবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে পাঁচ জেলার ফসলহারা কৃষকদের চোখে এখন শুধুই কান্না। অতিকষ্টে জন্মানো তাদের ধান তলিয়ে গেছে পানিতে। কেউ কেউ অকাল বন্যার শুরু থেকে আধা-পাকা ধান কেটেও নেন। সোনার ফসল ঘরে তোলার জন্য সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা অব্যাহত আছে এখনও। তবে এমন দুর্দিনে শীর্ষ দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রতিনিধিদের দৃশ্যত পাশে পাচ্ছেন না সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও নাটোরের এ মানুষগুলো। দুর্গতদের অভিযোগ- আওয়ামী লীগ-বিএনপির জনপ্রতিনিধি তথা বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা শুধু সাহায্যের আশ্বাসই দিচ্ছেন, বাস্তবে তারা দলের পক্ষ থেকে কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগের কোনো সাহায্য পাচ্ছেন না। সরকারি বরাদ্দ বিতরণের সময় শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন ফটো সেশনের জন্য। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দুর্গত মানুষজন আরও জানান, তাদের জন্য বরাদ্দ সরকারি ত্রাণ শুরু থেকে খুবই অপ্রতুল। ভোরে ন্যায্যমূলের চাল বিক্রির দোকানে দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না চাল-আটা। তবুও একটু সাহায্যের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছেন তারা। তাদের ভাষায়, ক্ষতির বিপরীতে সরকারি সাহায্য যতটুকু দরকার, তা না দিলে তাদের আগামী দিনগুলো অবর্ণনীয় কষ্টে কাটবে, থাকতে হবে না খেয়ে। এপ্রিলের শুরু থেকে অতিবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢল শুরু হয়। পানিতে তলিয়ে যায় লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসল। চলমান এ অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সময় দুর্গত মানুষের সঙ্গে কথা বলা ছাড়াও সংবাদ সম্মেলন করে বড় দু’দল। উদ্বিগ্ন নাগরিকদের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেও হাওরের বিপর্যয়কে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণার দাবি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, বাঁধ নির্মাণে জড়িত দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়ারও দাবি জানান উদ্বিগ্ন নাগরিকরা। এদিকে কিশোরগঞ্জের স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকেই ত্রাণমন্ত্রীর কাছে হাওরাঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি করেন। যদিও মন্ত্রী এ পরিস্থিতি হয়নি উল্লেখ করে ব্যাপারটি পাশ কাটিয়ে যান।
কিশোরগঞ্জ : অতিবর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে নজিরবিহীন বোরো ফসলহানির ঘটনা নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে তাদের এ তৎপরতা পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। বাস্তবে সাহায্যে এগিয়ে আসছেন না তারা। বিএনপি বলছে, এটি ‘মনুষ্য সৃষ্ট’ বিপর্যয়। বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতিই এর প্রধান কারণ। ক্ষয়ক্ষতির তুলনায় সরকারি সাহায্যও এত অপ্রতুল যে, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ জেলায় ৫৭ হাজার ৮৮৭ হেক্টর বোরো ফসল পানিতে ডুবে বিনষ্ট হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকালে কথা হলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহজাহান দাবি করেন, তারা বুধবার থেকে হাওর উপজেলা ইটনা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সাংগঠনিকভাবে তাদের ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেছেন। আপনারা কী দিলেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরাও কিছু দিয়েছি।

এদিকে, পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যায় দেশের হাওরাঞ্চলের ছয় জেলায় মোট দুই লাখ ১৯ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট লাখ ৫০ হাজার ৮৮টি পরিবার।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাওর এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার আগে শুক্রবার হাওর পরিস্থিতি নিয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠকে ক্ষয়ক্ষতির হালনাগাদ এ তথ্য তুলে ধরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ওই বৈঠক শেষে কমিটির সদস্য সচিব ও মন্ত্রণালয়ের যুগ্ন সচিব মোহাম্মদ মহসীন হালনাগাদ তথ্য সাংবাদিকদের সামনেও তুলে ধরেন।গতমাসের শেষ দিকে টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা তালিয়ে যায়। বোরো ধান কাটার এই মওসুমে হঠাৎ এই বন্যায় লাখ লাখ কৃষকের মাথায় হাত পড়ে। এরপর পানি বিষাক্ত হলে মাছ মরা শুরু হয়; তারপর মরতে থাকে হাঁস।পরে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রতিনিধি দল ওই এলাকা ঘুরে পানি পরীক্ষা করে বলে, প্রাথমিকভাবে ইউরেনিয়াম তেজস্ক্রিয়তার কোনো প্রমাণ তারা পাননি।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের দুই হাজার ৮৬০টি বাড়ি সম্পূর্ণ এবং ১৫ হাজার ৩৪৫টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।ছয় জেলায় মোট ২১৩ দশমিক ৯৫ মেট্রিক টন মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে; সুনামগঞ্জে তিন হাজার ৯০২টি হাঁস ও চারটি মহিষ মারা গেছে।এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত পরিবার প্রতি ৩০ কেজি চাল ৫০০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। রোববার সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা পরিদর্শনে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত ছয় জেলায় তিন লাখ ৩০ হাজার পরিবারের মধ্যে ত্রাণ হিসেবে চাল, ঢেউটিন ও নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
হাওরে তলিয়ে যাওয়া কাঁচাপাকা ধান হাতে দুই শিশু: নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান ইউনিয়নের সোনাইখালী গ্রামের বাসিন্দা গোলাবজান বিবির বয়স ৮০ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় সোজা হয়ে দাঁড়াতেও কষ্ট হয় তার। গত ২৫ এপ্রিল দুপুরে (১২টা-সাড়ে ১২টা) নীলপাড়ের সাদা সুতি কাপড় পরে খালি পায়ে অনেক লোকের মাঝে তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন সোনাইখালী সেতুর ওপর।সামনে টেংরাম হাওর। এই পথ দিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মদন উপজেলার উচিৎপুর গ্রামের কয়রা হাওরের দিকে যাবেন। মাঝে এখানে থামবেন। খবরটি পেয়েই এসেছেন গোলাবজান বিবি। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেন এই প্রতিনিধির সঙ্গে।
৮০ বছর বয়সী এই বৃদ্ধার স্বামী নেই, বেঁচে আছেন তিন ছেলেকে নিয়ে। ছেলেরা হাওরে মাছ ধরে। অন্যের জমিতে ধান চাষ করে। যা পায় তা দিয়েই পাঁচ নাতি-নাতনিকে নিয়ে বছর কেটে যায়। এবারের বন্যায় হাওরে চাষ করা ধান তলিয়ে গেছে। মাছ ভেসে গেছে। মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে তার প্রশ্ন, ‘আমরা এহন কি খাইয়্যাম? (কী খাবো) ক্যামনে বাচবাম? (কীভাবে বাঁচবো) গোলাবজান বিবি বললেন, ১৫-২০ দিন আগের সেদিনের ঘটনা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মনে থাকবে। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। দিনভর প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। রাতে শুনলাম আশপাশের মানুষরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাঁধের দিকে ছুটছে। আমার ছেলেদের ঘুম থেকে তুলে খবর নিতে বললাম, বাইরে কি হচ্ছে। তারা খবর নিয়ে এলো, বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের পানিতে বাঁধ ডুবে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে। আমার তিন ছেলেও গেলো সেখানে। রাতভর চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভোরের দিকে সবকিছু মুহূর্তে শেষ হয়ে গেলো। মলিন মুখে বাড়ি ফিরলো সবাই। আমার তিন ছেলেও ফিরলো। তাদের কাছে জানলাম সবই। পূবের আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়ে এলে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমিও হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি পানি আর পানি। কিচ্ছু নাই। সব ডুবে গেছে। কোথায় ধান? কোথায় বাদাম? সেসবের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মরার এতো পানি কোথা থেকে এলো কিছুই বুঝলাম না। জীবনে এত পানি দেখিনি।মন্ত্রী আসবেন জেনে একই উপজেলার আটিকান্দা গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব কৃষক রমজান আলী ফকিরও মলিন মুখে এসেছিলেন সোনাইখালী ব্রিজের ধারে। কিছু দেবে কিনা কিংবা কী চান জানতে চাইলে উত্তরে তিনি আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘ঘরে খাবার নাই। না ডুবলে এতদিনে নতুন ধান ঘরে উঠে যেতো। কিন্তু বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে গেছে ধান। সেই ধান যা পেরেছি কেটে এনেছি। কিন্তু তাতে চাল পাওয়া যায়নি। সব চিটা হয়ে গেছে। কারণ পরিপক্ক হয়নি।

রমজান আলী ফকির আরও জানান, টেংরাম হাওরে ১৮ কাঠা জমিতে ইরি ২৯ লাগিয়েছিলেন তিনি। হাওরের পাশের উঁচু জমিতে লাগিয়েছিলেম বাদাম। সবই তলিয়ে গেছে পানিতে। তার কথায়, ‘মাসখানেক আগে থেকেই পানি বাড়ছিলো। কারণ বৃষ্টি হয়েছে অনেক। প্রথম ভাবলাম এটা হয়তো বৃষ্টির পানি, বৃষ্টি থেমে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো না। কারণ এতে বৃষ্টির পানির সঙ্গে যোগ হয়েছে উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢল। ক্রমশ পানি বৃদ্ধির কারণে একের পর এক বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ফলে চাষ করা ধান একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে।কুল কিনারা না পেয়ে ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে হাওরে চাষ করা ধান কেটে আনতে নেমে যান রমজান আলী ফকির। কেটে আনলেনও। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। কারণ ধানই যে পাকেনি! তিনি বলেছেন, ‘পাকার আগেই পানিতে ডুবে যাওয়া ধান কেটে এনেছি। আর মাত্র ১০-১২ দিন সময় পেলেই ধান পেকে যেতো। তখন ডুবে যাওয়া ধান থেকেও কিছু চাল পেতাম। এখন তো আমরা নিঃস্ব। এতদিন হলো কোনও সাহায্য পেলাম না। কেউ দেখতেও এলো না। আজ মন্ত্রী আসবে বলে কত লোকজনই না দেখলাম।
একই দিন সকাল সোয়া ১০টায় নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কথা হয় একই উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয় এসেছিলেন বন্যাদুর্গত হাওরবাসীকে ত্রাণ দিতে। সেই ত্রাণের আশায় স্কুল মাঠে টাঙানো সামিয়ানার নিচে পাতা বেঞ্চে বসেছিলেন বারহাট্টা উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। বয়স আনুমানিক ৫০-৫৫ বছর। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের দেওয়া স্লিপ না থাকায় ত্রাণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে গালে হাত রেখে বিষণœ মনে বসেছিলেন তিনি।পানিতে নেমে ধানা কাটার চেষ্টা করে ৩৫ কেজি ধান তুলতে পেরেছেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০-২২ কেজি চাল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। কিন্তু এই চাল দিয়ে বছর যাবে কীভাবে? তাই স্থানীয় প্রশাসনের মাইকিং শুনে তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসেছেন ত্রাণের আশায়।

আনোয়ার হোসেন বলেন, গত ৩০-৩৫ বছরে এ অঞ্চলের হাওরে এত পানি আসেনি। এ বছরই হঠাৎ পানি এসে আমাদের সবকিছু ডুবিয়ে দিলো। এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গেলো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সারাবছরের সঞ্চয়। সিঙ্গুর হাওরের ৯ কাঠা জমিতে চাষ করেছিলাম ইরি ২৯। সকালে হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি সব পানির নিচে।এরপর চোখেমুখে অন্ধকার নেমে আসায় পানিতে নেমে ধানা কাটার চেষ্টা করে ৩৫ কেজি ধান তুলতে পেরেছেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১২-১৪ কেজি চাল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। কিন্তু এই চাল দিয়ে বছর যাবে কীভাবে? তাই স্থানীয় প্রশাসনের মাইকিং শুনে তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসেছেন ত্রাণের আশায়। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের দেওয়া স্লিপ না থাকায় ত্রাণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে বসেছিলেন তিনি।আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত ৩০-৩৫ বছরে এ অঞ্চলের হাওরে এত পানি আসেনি। এ বছরই হঠাৎ পানি এসে আমাদের সবকিছু ডুবিয়ে দিলো। এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গেলো সারাবছরের সঞ্চয়। সিঙ্গুর হাওরের ৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম ইরি ২৯। সকালে হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি সব পানির নিচে।একই মাঠে কথা হয় বারহাট্টা উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের কৃষক হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, স্থানীয় ধামারুক হাওরের ৮ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তিনি। পাননি এক কেজি ধানও। সবই ডুবে গেছে। ঘরের ১৩টি হাঁসও ভেসে গেছে বানের পানিতে। ৪টি ছাগল বিক্রি করে দিয়েছেন ঘাসের অভাবে।একই ইউনিয়নের রহমত আলী ডাকায়া টেংরাম হাওরের ১৬ কাঠা জমিতে চাষ করেছিলেন ইরি। তারও জমি পুরোটাই তলিয়ে গেছে। সেই তলিয়ে যাওয়া ধান যতটুকু পেরেছেন কেটে এনে দেখেন অধিকাংশই কাঁচা। সব মিলিয়ে ২৬-২৭ কেজি হবে। সেগুলোই ছেটে শুকানোর চেষ্টা করছেন এখন। পথের ধারে শুকাতে দেওয়া এই ধান দুই দফায় বৃষ্টিতে ভিজেছে। তাই ওই ধানে যে কতো চাল পাওয়া যাবে আর তা দিয়ে কী হবে সেইসব ভেবে দিশেহারা তিনি।মদন উপজেলার উচিতপুর গ্রামের বাসিন্দা ৬৭ বছরের বৃদ্ধ সেকেন্দার মিয়ার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হলো বালুর ট্রলার ঘাটে। তিনি বলেন, মদনের পাগলার হাওরে ১১ কাঠা জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গেছে। যতোদূর পেরেছি কেটে এনেছি।রাস্তার ওপরে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা দূরের একটি স্তুপ হাত দিয়ে দেখিয়ে সেকেন্দার আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ওই যে আমার ধান। ঢেকে রেখে দিয়েছি পলিথিন দিয়ে। মাড়াইও করতে পারিনি। বৃষ্টি হচ্ছে। কীভাবে মাড়াই করবো? গরু ছিল তিনটি। শুকনো জায়গা নেই। বাঁধের ওপর রেখেছিলাম। বাধ ভেঙে যাচ্ছে দেখে কোনোরকম গরুগুলোকে রাস্তায় তুলতে পেরেছিলাম। তা না হলে তো বাঁচাতে পারতাম না। গরুর খাবার ঘাস, খড় কিছুই নেই। সব ডুবে গেছে। তাই বিক্রি করে দিয়েছি। ভালো দাম পাই নাই। অর্ধেকের চেয়েও কম দামে বেচে দিয়েছি।কয়রা হাওর পড়ে নির্মিত মঞ্চে থেকে ত্রাণমন্ত্রীর বিতরণ করা ত্রাণসামগ্রী হিসেবে দেওয়া ১৫ কেজি চাল ও নগদ ৫০০ টাকা পেয়েছেন মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক তোরাব আলী। সকাল থেকে অপেক্ষা শেষে বেলা ২টা দিকে মাথায় চালের ব্যাগ নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেন তিনি। সঙ্গে ৫ ও ৭ বছর বয়সী দুই মেয়ে। হাঁটতে হাঁটতেই কথা হয় তার সঙ্গে।কয়রা হাওরে লাগানো ১৯ কাঠা জমির ধান কীভাবে পানির নিচে চলে গেলো তা জানিয়ে কৃষক তোরাব আলী বললেন, হাওরের মধ্য দিয়ে গড়ে তোলা বাঁধ আমরা বিনা পারিশ্রমিকে ঠিকাদারের শ্রমিকদের নিয়ে একসঙ্গে নির্মাণ করেছিলাম। ভেবেছিলাম বাধ রক্ষা করা গেলে জমির ধান ও বাদাম উভয়ই রক্ষা করা যাবে। কিন্তু পারিনি।

নাটোর: প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত নাটোর জেলার সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলার সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে বন্যা মোকাবিলা প্রস্তুতি সভা শেষে নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন এ নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এলাকা না ছাড়ার পরামর্শ দেন। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মনিরুজ্জামান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকার, সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আহসান, নলডাঙ্গার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. রেজা হাসান, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ, সিংড়ার পৌর মেয়র জান্নাতুল ফেরদৌস, সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল আলম, সিংড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাত হোসেন, সিংড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, কৃষি বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাসহ জেলার সরকারি সব কার্যালয়ের কর্মকর্তারা।এক ঘণ্টাব্যাপী সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কর্মকর্তাদের ছুটির দিনেও কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশেষ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), কৃষি বিভাগ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও দুর্যোগ ত্রাণ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের অধিক সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলোকে পরামর্শ দেন।এর আগে শাহিনা খাতুন আগাম বন্যাকবলিত সিংড়া ও গুরুদাসপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) উপস্থিত ছিলেন।