আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্রিয়তার কারণেই হোলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার পর জঙ্গিরা দেশে বড় ধরনের কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে পারেনি বলে জানিয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে যে বাড়িতে অপারেশন ঈগল হান্টে চারজন নিহত হন, সেই বাড়িটি জঙ্গিরা তাদের অস্ত্র-বিস্ফোরকের ভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহার করত বলে দাবি করে পুলিশ।শনিবার সকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।খুব দক্ষতার সঙ্গে অভিযান ২টি সম্পন্ন করা হয়েছে দাবি করে চাপাইনবাবগঞ্জে নিহত জঙ্গি আবদুল্লাহ ঝিনাইদহ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে জঙ্গিদের আত্মহনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানিয়ে মনিরুল ইসলাম দাবি করেন, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সক্রিয়তার কারণেই হোলি আর্টিজান ও শোলাকিয়ার পর জঙ্গিরা সারাদেশে বড় ধরনের কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটাতে পারেনি।জঙ্গিদের অর্থ যোগানদাতাদের এখনো খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে জঙ্গিবাদকে রুখতে সকল এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে গত ২২ এপ্রিল ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের একটি বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।অভিযান থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা না গেলেও জঙ্গি আস্তানা থেকে ৩টি সুইসাইডাল ভেস্ট, ৬টি বোমা, একটি বিদেশি পিস্তল, ৭ রাউন্ড গুলি, ১৫টি জিহাদী বই, বিপুল সংখ্যক বিস্ফোরক ও কেমিকেল ভর্তি ২০টি কন্টেইনার উদ্ধার করা হয়।

আর ২৯ এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়িতে অভিযানে রফিকুল আলম আবুসহ ৪ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় এক নারী ও শিশুকে। শিবগঞ্জের মোবারকপুর ইউনিয়নের ত্রিমোহিনী গ্রামে আমবাগান ঘেরা আধাপাকা ওই বাড়িতে বৃহস্পতিবার দুদিনের অভিযান শেষে পুলিশ একটি আগ্নেয়াস্ত্র ও সুইসাইড ভেস্ট থাকার কথা জানিয়েছিল।এছাড়া বুধবার সকালে অভিযান শুরুর পর বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত এক দফা গুলিবর্ষণ এবং কয়েকটি বিস্ফোরণের কথা জানিয়েছিল পুলিশ। এই অভিযানে নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনেরই নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম শনিবার ঢাকায় তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন,চাঁপাইনবাবগঞ্জের জঙ্গি আস্তানা থেকে যেসব বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে, সেগুলো দেখে মনে হয়েছে বাইরে থেকে সেগুলো আনা হয়েছে।ধারণা করা হচ্ছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানাটি নব্য জেএমবি সদস্যদের স্টোর হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হত।

সাম্প্রতিক অভিযানগুলোর মধ্যে অপারেশন ঈগল হান্ট’কে নিখুঁত বলে মনে করছেন এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।এই অভিযানে পুলিশের কেউ হতাহত হয়নি; বাড়ির ভেতর থেকে জীবিত বের করে আনা হয় এক নারী ও এক শিশুকে।নিহতদের মধ্যে দুজন আত্মঘাতী হয়েছেন বলে ধারণা মনিরুলের। বাকি দুজন পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে মারা যেতে পারেন বলে মনে করেন তিনি।নিহতদের একজন স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল আলম আবু বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান মনিরুল, যার স্ত্রী সুমাইয়া ও এক সন্তানকে জীবিত বের করে আনা হয়।

বাকি তিনজনের মধ্যে নব্য জেএমবির নেতা আবদুল্লাহ রয়েছেন বলে পুলিশের ধারণা, যার ঝিনাইদহের বাড়িতে গত ২২ এপ্রিল অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছিল।নিহতদের দুজন ঝিনাইদহ থেকে থেকে এসেছিলেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে সুমাইয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানান মনিরুল।তিনি মনে করছেন, ঝিনাইদহ থেকে আসা আবদুল্লাহ ও তার সঙ্গী বিস্ফোরক নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানায় গিয়েছিলেন। খোলা বাজার থেকেই ওইসব বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার হওয়া বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো খুব শক্তিশালী বা উন্নত এটা বলা যাবে না। তবে সেগুলোর পরিমাণ অনেক বেশি বলে ধ্বংস ক্ষমতা বেশি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আস্তানায় যেসব বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তা অন্য কোথাও ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল বলে মনে করছেন মনিরুল। সেখানে সুইসাইড ভেস্টের পাশাপাশি চারটি অবিস্ফোরিত বোমাও পাওয়া গিয়েছিল বলে জানান তিনি।মসলা বিক্রেতা আবু (৩০) স্ত্রী সুমাইয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুলের দাবি। তিনি বলেন, আবু তার স্ত্রীর হাত ধরে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে।তবে আবু ও আবুর স্ত্রী উভয়ের পরিবারের জামায়াত ইসলামীতে যুক্ত থাকার তথ্য স্থানীয়দের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে দাবি করেন মনিরুল। যে বাড়িতে আবু স্ত্রী ও মেয়েদের নিয়ে থাকতেন, তার পাশের গ্রাম চাচরায় তার পৈত্রিক বাড়ি। তার বাবা আফসার আলী একজন দিনমজুর।

এক সময় মাদ্রাসায় পড়া আবু একজন ভ্রাম্যমাণ মসলা বিক্রেতা ছিলেন। প্রায় নয় বছর আগে সুমাইয়া খাতুনের সঙ্গে বিয়ের পর একই উপজেলার আব্বাস বাজারে শ্বশুরবাড়িতেই আবু থাকতেন বলে তার মা ফুলছানা বেগম জানান। ছেলেবেলায় আবু চাচরা গ্রামের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন বলে জানালেও কোন শ্রেণি পর্যন্ত তিনি পড়াশোনা করেছেন সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি তার মা।শুক্রবার রাতে আবুর চাচা ইয়াসিন আলী লাশ গ্রহণ করলেও কিছুক্ষণ পর আবার ফিরিয়ে আনে পুলিশ।

শিবগঞ্জ থানার ওসি হাবিবুল ইসলাম জানান, আবুর মা-বাবা কেউ না আসায় চাচাকে লাশ দেওয়া নিরাপদ মনে করেননি তারা।জঙ্গিদের অর্থের উৎস কী, সেই বিষয়ে এখনও পুরোপুরি তথ্য পুলিশের কাছে নেই। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, তাদের কারা অর্থ দেন, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।এখানে কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষের ও রাজনৈতিক দলের ইনভলবমেন্ট আমরা দেখেছি। সেই বিষয়টা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এটা কেস টু কেস বিবেচনা করতে হবে।এছাড়া জঙ্গিরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে, কেউ কেউ চাকরি করে সংগঠনের তহবিল জোগান বলে জানান তিনি। সংগঠনের সদস্যদের কাছের কিছু লোক বিদেশ থেকে অর্থ পাঠান বলেও তিনি জানান।বিদেশি অর্থায়নের বিষয়ে মনিরুল বলেন, কখনও কখনও দেখেছি জেএমবির কোনো কোনো সদস্য জাল মুদ্রা ব্যবসায় জড়িত। এই মুদ্রাগুলো একটি বিশেষ দেশ থেকে তৈরি হয়, যা অন্যদের জাল মুদ্রা, ভারতীয় জাল মুদ্রা। সেক্ষেত্রে কখনও কখনও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্ততার কথা বিভিন্ন সময়ে এসেছে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারও করা হয়েছে। মনিরুল নাম না বললেও তার ইঙ্গিত পাকিস্তানের দিকে। গত বছর দেশটির এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠার পর তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। দেশটির জঙ্গি মদদ দেওয়ার কথা সরকারের মন্ত্রীরাও বলে আসছেন। সংবাদ সম্মেলনে মনিরুলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ-কমিশনার মহিবুল ইসলাম, প্রলয় কুমার জোয়ারদার, রাকিবুল ইসলাম প্রমুখ।