নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইনে নতুন হার ১২ শতাংশে নামানো উচিত।একবারে না হলেও ধাপে ধাপে ভ্যাট কমিয়ে আনা যেতে পারে। নতুবা এই নতুন ভ্যাট আইন উৎপাদক ও ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে।শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশে।লষণে (তৃতীয় সংস্করণ) এ কথা বলেছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, কোনো দাম না বাড়িয়ে ভ্যাটসহ বিদ্যুতের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা উচিত। স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখার সুপারিশও করেছে সিপিডি। পেট্রোলিয়াম পণ্য, সিমেন্ট ও মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক না বসানোর কথাও বলেছে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আয়করের নিম্নতম স্তরটি ১০ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে ৭ শতাংশ করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

চলতি অর্থবছরের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রকাশ উপলক্ষে মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সিপিডি। এতে সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, শিল্পের উন্নতি হচ্ছে। কিন্তু সেভাবে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, যে পরিমাণ তৈরি পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানি হচ্ছে, সেই অনুসারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তাঁর মতে, অর্থনীতিকে অতিমাত্রায় প্রবৃদ্ধিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হচ্ছে। এটি অর্থনীতির অত্যন্ত খন্ডিত ও অসম্পূর্ণ চিত্র। সবচেয়ে দুস্থ মানুষটি অর্থনীতি থেকে কতটা পেল, সেটা বিবেচ্য হওয়া উচিত।

বিনিয়োগ সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ব্যূহ ভেদ করতে পারছি না। জিডিপিতে যে বাড়তি বিনিয়োগ আসছে, তা রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ থেকে আসছে। ভোগের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অংশটি আসছে, তাও রাষ্ট্রের ভোগ। ভোগ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অর্থনীতি ধাবিত হচ্ছে রাষ্ট্র দিয়ে।ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের দুর্বলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, অবৈধ উপায়ে অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। নির্বাচন যত সামনে আসবে, অর্থ পাচার তত বাড়বে। আবার আফ্রিকার দেশগুলোতে বিনিয়োগই বেশি লাভজনক মনে করেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। পুঁজি দুর্ভিক্ষের দেশ এখন পুঁজি রপ্তানির দেশে পরিণত হচ্ছে। আর ব্যয়বহুল ভোগ কাঠামোর দিকে যাচ্ছি। এর উদাহরণ, এ দেশে বিএমডব্লিউ ব্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি বিক্রিতে এশিয়ায় পঞ্চম বাংলাদেশ।মধ্যম আয়ের দেশ কিংবা উন্নত দেশ হওয়ার জন্য যে আকাঙ্খা, এর সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ প্রবাহের বিষয়টি মিলছে না বলে মনে করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে, বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত শিল্পায়ন হচ্ছে না। প্রবৃদ্ধি হতে হবে কর্মসংস্থানমুখী।

ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবর্তন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, বৃহত্তম ঋণ গ্রহণকারী যখন মালিক হয়ে যান, তখন তা চিন্তার বিষয়। ইসলামী ব্যাংকের চলমান ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ভূমিকা থাকা দরকার, তা দেখছি না। ইসলামী ব্যাংকের পরিবর্তন মসৃণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা থাকা দরকার।অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। উপস্থিত ছিলেন সিপিডির পরিচালক আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ।

এদিকে, গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমার চিত্র তুলে ধরে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পকে আগামী দুই বছর উৎসে করের বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছে বিজিএমইএ।শনিবার ঢাকায় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইআই) ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বর্তমান বাজার পরিস্থিতিকে ‘সঙ্কটজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে আরও বেশি কিছু দাবি তুলে ধরেন।পোশাক রপ্তানির উপর উৎসে কর আগামী দুই বছরে জন্য প্রত্যাহার।আগামী পাঁচ বছরের জন্য করপোরেট ট্যাক্স ২০ শতাংশের বদলে ১০ শতাংশ নির্ধারণ।বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া।বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ বাড়াতে স্থিতিশীল রাজস্ব নীতি গ্রহণ।চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্যে রপ্তানিমূল্যের ওপর ১.৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার প্রস্তাব করা হলেও পরে ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী তা শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে নামিয়ে আনেন।বিজিএমইএ সভাপতি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ১০ বছর যেখানে এ খাতের গড় রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ, সেখানে চলতি বছর তা কমে ২ দশমিক ২১ শতাংশ হয়েছে। অথচ গতবছরও তা ১০ শতাংশ ছিল।নতুন বাজারে প্রবেশের চেষ্টায় আশাব্যাঞ্জক ফল না পাওয়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট ও ব্যাংকের সুদের হার বেশি থাকায় বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিকে প্রবৃদ্ধি কমার পেছনে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।

সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বিগত চার বছরে পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট এক হাজার দুইশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক কমে গেছে প্রায় চার লাখ।এই পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য উৎসে কর প্রত্যাহারের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, সুতা, কাপড়, এক্সেসরিজ, ওয়াশিং ও এন্ড প্রোডাক্টে ট্যাক্স নেওয়া হয়। এক পণ্যে আর কতবার ট্যাক্স দেব? বাংলাদেশের প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক খাতই মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের যোগান দেয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বিশ্ব বাজারে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে বলে বিজিএমইএ সভাপতি জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান দুই বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ‘নীরব মন্দার’ কারণে রপ্তানি ‘আশঙ্কাজনক’ হারে কমছে। চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।অন্যদের মধ্যে বিজিএমইএ-এর সহ-সভাপতি মাহমুদ হোসেন খান, মোহাম্মদ নাসিরসহ কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।