আইন মন্ত্রণালয়কে আইনের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেছেন, এমন কিছু করা নির্বাহী বিভাগের উচিৎ হবে না, যাতে বিচার বিভাগ বিক্ষুব্ধ হয়।বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে সোমবার আপিল বিভাগের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া প্রেষণে থাকা বিচারকের বিদেশযাত্রা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য আসে।অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে তিনি বলেন, আপনারা যদি আইন না জানেন, তাহলে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন। সংবিধান অনুসারে ব্যাখ্যা আমরা দেব। নির্বাহী নয়। এগুলো মনে করে চলবেন।

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট প্রকাশ না করে সোমবার আবারও সময়ের আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকা ওই গেজেট প্রকাশে সরকার আরও সময় চাওয়ায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারকের আপিল বেঞ্চ উষ্মা প্রকাশ করে এবং শুনানি শেষে আরও দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়।শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল সময়ের আবেদন জমা দিলে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, এটা কী?অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, সময়।তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, কারণটা কী?অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রসেস চলছে।প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা হাসব না কাঁদব? হাসতে গেলেওতো কষ্ট হয়। যাই হোক, আমি কিছু বলছি না। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। কিছু অনিয়ম আছে। এগুলো নিয়ে সারাজীবন নয়। আমরা চাচ্ছি একটা সিস্টেমে চলে আসতে। প্রধান বিচারপতি অনিয়ম থেকে নিয়মে আসতে গেলে বলে, গেল গেল।এরপর প্রেষণে থাকা বিচারকদের প্রেষণে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে পাঠানো নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট আর আইন মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক টানাপড়েনের প্রসঙ্গ আসে প্রধান বিচারপতির কথায়। পত্রিকায় বলা হয়, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্ব। আপনার মিনিস্ট্রিকে (আইন মন্ত্রণালয়) বলবেন, জেনারেল ক্লজ অ্যাক্টের ২১ পড়তে। সরকারকে বলবেন, যেসব বিচারক প্রেষণে আছে, তারা সরকারি কর্মচারী না। সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছিল প্রেষণে থাকাদের মধ্যে কারা বিদেশে যায় তাদের নাম।নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ দিতে গত ২৮ র্মাচ আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর প্রথম ধাপে প্রেষণে ১৭ জন বিচারককে বিভিন্ন মেয়াদে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর জন্য ৩ মে একটি অফিস আদেশ জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।

এরপর ৯ মে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ সংক্রান্ত’ একটি সার্কুলার জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রেষণে থাকা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিদেশে না যেতে নির্দেশ দেওয়া হয় সেখানে। এই নির্দেশ না মানলে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সেখানে হুঁশিয়ার করা হয়।এরপর গত ১৬ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে গতবছর মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা একটি পত্রের বরাতে সেখানে বলা হয়, অধস্তন আদালতের বিচারকরা প্রেষণে থাকলে তাদের বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার আবশ্যকতা নেই।আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির অনুশাসনের কথা বললেও সুপ্রিম কোর্ট ২৩ মে আরেকটি পরিপত্র জারি করে ওই ১৭ জনকে বিদেশ না পাঠানোর নির্দেশনাই বহাল রাখে।

সোমবারের শুনানিতে সেই প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, যত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ডেপুটেশনে দিয়েছি, যদি তাদের প্রত্যাহার করি, তাহলে কারও কিছু করার নেই। বিচারকদের ডেপুটেশনে দিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। ১৮৯৭ সালের সেকশন জেনারেল ক্লজ অ্যাক্ট ২১ দেখেন। যদি না হয় এটা ডিলিট করে দেন। এটা এতো দিন ধরে চলে আসছে।অ্যাটর্নি জেনারেলকে তিনি বলেন, আপনারা বিচার বিভাগকে বিক্ষুব্ধ করবেন না, রাষ্ট্রপতির অনুশাসন বলে এমন কিছু করতে পারেন না। রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো ফাইল পাঠিয়ে যদি করতে বলা হয় তখন তিনি করেন, আর ‘না’ বললে ‘না’ বলেন। তাই বলছি ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।তারা মনে করে সুপ্রিম কোর্টকে আদেশ করবে, তা ভুল করবে। তারা আইন না জেনে একের পর এক ব্যবধান সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র এ রকম করতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের প্রত্যোকটা সিদ্ধান্ত সিনিয়র বিচারকরা চিন্তা করে নেয়। তারা (আইন মন্ত্রণালয়) যদি মনে করে যে, আইনের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে দিবে তাহলে খুব ভুল করবে।

নির্বাহী বিভাগকে আইনের ব্যাখ্যা না দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর! মারাত্মক হয়ে যাবে! তারা যদি আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে বলে এটাই কারেক্ট, খুব ভুল হবে।ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে আপিল শুনানিতে এমিকাস কিউরিগণ মতামত দিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র সুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বেঞ্চে আজ নবম দিনের মতো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে বিষয়টির ওপর মতামত তুলে ধরছেন আদালত নিযুক্ত এমিকাস কিউরিগন।বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধানের পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট আইনজীবী ড.কামাল হোসেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের আপিল শুনানিতে আজ এমিকাস কিউরির মতামত দেয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ড.কামাল হোসেন বলেন, সংবিধান হলো দেশের সর্বোচ্চ আইন। সেখানে কার কি ক্ষমতা তা নির্ধারণ করা আছে। বিচার বিভাগ, এর দায়িত্ব হলো সবাই নিজে নিজের সীমারেখার মধ্যে থাকছে কিনা, যদি সীমা লংঘন করে থাকে, তখন বিচার বিভাগ বলে যে, না এখানে সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে। বিচারক অপসারণে কি বিধান থাকা উচিৎ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেটা ছিল সেটাই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল। ষোড়শ সংশোধনী না থাকলে আমাদের যেটা ছিল সেটাই থাকবে। সেটার উপর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ও আছে।

মতামতে এমিকাস কিউরি হিসেবে এম আই ফারুকী বলেন,পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সুপ্রিমকোর্ট সামরিক শাসনামলে জারি করা সব ফরমান বাতিল করলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল ব্যবস্থাকে রেখে দিয়েছে। এরপর সরকারও পঞ্চদশ সংশোধনীতে এ ব্যবস্থা রেখে দেয়। তারপর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করে। এই ষোড়শ সংশোধনী স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোর লংঘন। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত হতে হবে বিচারকদের দিয়েই, রাজনীতিবিদদের দিয়ে নয়।সোমবার এম আই ফারুকী ও ড.কামাল হোসেন ও এএফ হাসান আরিফ, আব্দুল ওয়াদুদ ভূইয়া তাদের মতামত উপস্থাপন করেন। এর আগে এমিকাস কিউরি হিসেবে বিষয়টির ওপর মতামত তুলে ধরেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিষ্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিষ্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, টিএইচ খানের পক্ষে তার ছেলে আফজাল এইচ খান।এছাড়াও এর আগে শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি পেশ করেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রিট আবদনকারী পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

গত ৮ ফেব্র“য়ারি বিষয়টির ওপর মতামত দিতে ১২ বিশিষ্ট আইনজীবীকে এমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র ও বিশিস্ট আইনজীবী হচ্ছেন- টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিষ্টার রফিক-উল হক, ব্যারিষ্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ, এ এফ হাসান আরিফ, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, ব্যারিষ্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এম আই ফারুকী, এ জে মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিষ্টার ফিদা এম কামাল।উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের ১৬৫ পৃষ্ঠার পূর্নাঙ্গ রায় গত বছর ১১ আগস্ট প্রকাশ করা হয়। বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বৃহত্তর বেঞ্চ গতবছর ৫ মে বিষয়টির ওপর সংক্ষিপ্ত রায় দেয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য ছিলেন- বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। রায়টি লিখেছেন, বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বেঞ্চের অপর বিচারপতি কাজী রেজাউল হক। তবে বেঞ্চের কণিষ্ঠ বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আরেকটি রায় দিয়েছেন। উচ্চ আদালতের রুলস অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে যে রায় দেয়া হয়, সেটাই চূড়ান্ত হবে।