ব্যাংকে এক লাখ টাকার বেশি থাকলে এখন আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে সরকারকে।বছরের যে কোনো সময় ব্যাংক হিসেবে এক লাখ টাকা ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হলে এতদিন ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হত; নতুন অর্থবছরের বাজেটে শুল্ক ৮০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার সংসদে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, এতদিন বছরের যে কোনো সময় একাউন্টে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডেবিট ও ক্রেডিটের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হত না। এখন ১ লক্ষ টাকার একাউন্টের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে।ব্যাংক একাউন্টে লেনদেন ১ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে হতে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে হতে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার ৫০০ টাকা, ১ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে হতে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ৭ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে বিদ্যমান ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।

বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ‘ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন অ্যাট অল লেভেলস’ নীতি ও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নতির ফলে ব্যাংকিং খাতে লেনদেনের আকার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিবেচনায় রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে দি এক্সাইজ এন্ড সলট অ্যাক্ট, ১৯৯৪ সংশোধনীর এই প্রস্তাব করছি।এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও সার্কভুক্ত দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমান টিকেটে আবগারি শুল্কের বিদ্যমান পরিমাণ অপরিবর্তিত রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।সার্কভুক্ত দেশ ছাড়া এশিয়ার অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১ হাজার টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা; ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ১ হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টাকা আবগারি শুল্কের প্রস্তাব করেছেন তিনি।বিমানযাত্রীদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য এই শুল্ক এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ টিকেটের সঙ্গে যুক্ত করে আদায় করবে, বলেন তিনি।

এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ভ্যাট আইন নতুন অর্থবছর থেকে কার্যকরের ঘোষণা এসেছে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বাজেট প্রস্তাবে, যাতে পণ্য ও সেবা বিক্রির ওপর অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। এই হারে ভ্যাট আদায়ের মাধ্যমে ৯১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের আশা করছেন মুহিত, যা এনবিআরের মাধ্যমে তার দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ পরিকল্পনার ৩৬.৮ শতাংশ।বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের এই বাজেটে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী।তিনি বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপিত হয়েছে এবং তাতে ভোক্তারা ও ব্যবসায়ীরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আমি ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশেই বহাল রাখার প্রস্তাব করছি। মুহিত বলেন, মূল্য সংযোজন কর এক ও অভিন্ন হারে প্রয়োগ করা হবে এবং আগামী তিন বছর তা অপরিবর্তিত থাকবে।২০১২ সালের ‘মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন’ অনুযায়ী ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর করার কথা ছিল গত বছরের ১ জুলাই থেকে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে তা পিছিয়ে দেয় সরকার।তখন বিদ্যমান প্যাকেজ ভ্যাটের হার বাড়িয়ে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট নেওয়া হবে।

ব্যবসায়ীরা তা আরও পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকলেন মুহিত।তবে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভ্যাট অব্যাহতির সীমা বছরে ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা করার প্রস্তাব রেখেছেন তিনি।অর্থাৎ মাসে গড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারধারী প্রতিষ্ঠানের কোনো কর দিতে হবে না। সেই সঙ্গে, টার্নওভার করের সীমা বছরে ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব তরেছেন অর্থমন্ত্রী।অর্থাৎ যেসব প্রতিষ্ঠানের মাসিক টার্নওভার গড়ে ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার নিচে, তাদের ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে।এতদিন ৩০ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ক্ষেত্রে ৩ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল।মুহিত বলেন, এটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য একটি অনন্য সুযোগ যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নেই। এছাড়া, ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রস্তাব অনুসারে নতুন ভ্যাট আইন ও বিধিমালার পদ্ধতিগত সহজীকরণ সংক্রান্ত কতিপয় অন্যান্য সংশোধন আনা হয়েছে।

বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৭২ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ৮৫ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।এছাড়া নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ২৩ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৩৮ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৪৪ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।বিদায়ী অর্থবছরের মূল বাজেটে মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা, আদায় সন্তোষজনক না হওয়ায় তা সংশোধন করে ২ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।২০১৬-১৭ অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সংশোধন করে তা ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।

সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা আগামী অর্থবছরেও আগের মতোই আড়াই লাখ টাকা থাকছে।তবে প্রতিবন্ধী করদাতাদের ক্ষেত্রে খানিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তাতে তিনি এই প্রস্তাব করেছেন।নতুন অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা একই রাখার প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী করায় যাদের বার্ষিক আয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার কম, আগের মতোই তাদের কোনো কর দিতে হবে না।২০১৫-১৬ অর্থবছরে ব্যক্তি শ্রেণির ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা ২ লাখ ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়। পরের বছর তা একই রাখা হয়।বজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী করমুক্ত আয়সীমা একই রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, বাংলাদেশে করমুক্ত আয়ের সীমা মাথাপিছু আয়ের ২০০ শতাংশের বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ অনুপাত ১০০ শতাংশের মধ্যে থাকে। এ ছাড়া আমাদের মুদ্রাস্ফীতিও এ মুহূর্তে কম, পাঁচ শতাংশের মতো।ফলে আগামী বছরে করমুক্ত আয়ের সাধারণ সীমা ও করহারে কোনো পরিবর্তন আনা হচ্ছে না।এক্ষেত্রে নারী ও প্রবীণ (৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে) করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা আগের মতো তিন লাখ টাকা থাকছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও করমুক্ত সীমা থাকছে ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা।প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার স্থলে ৪ লক্ষ টাকা প্রস্তাব করছি।

প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি তাদের বাবা-মা বা আইনানুগ অভিভাবকদের করমুক্ত আয়সীমাও ২৫ হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে।করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণে বিতর্ক অবসানে একটি নীতিগত দর্শন থাকা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন মুহিত।তিনি বলেন, মাথাপিছু আয়ের অনুপাত ও মূল্যস্ফীতি-এ দুটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারিত হতে পারে।দেশের অর্থনীতিতে রেমিটেন্সের গুরুত্ব অনুধাবন করে তা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, গত এপ্রিল মাসে তার আগের মাসের তুলনায় কিছু বাড়লেও অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো কমেছে ১৬ শতাংশ।

প্রবাসীরা এপ্রিল মাসে ১০৯ কোটি ২৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। মার্চে পাঠিয়েছিলেন ১০৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা মোট এক হাজার ২৮ কোটি ৭২ লাখ (১০.২৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের একই সময়ে দেশে এসেছিল ১ হাজার ২২৫ কোটি ডলার। সে হিসাবে এই ১০ মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ শতাংশ।বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রাণ রেমিটেন্সের এই নিম্নমুখী প্রবণতায় উদ্বেগ জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী নিজেও।এমন প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ইআরএফের সঙ্গে এক প্রাক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ওপর ব্যাংক থেকে কোনো মাশুল নেওয়া হবে না বলে জানান। বৃহস্পতিবার বাজেট বক্তৃতায়ও মুহিত রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপের কথা বলেন।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাস আয়ের গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা বিবেচনায় রেখে তা বৃদ্ধির জন্য নানামুখী পদক্ষপে গ্রহণ করা হয়েছে।এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রবাস আয় প্রেরণ ব্যয় হ্রাস, বিদেশে র্কমরত ব্যাংকের শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে রেমিটেন্স প্রেরণে দক্ষ করে তোলা, প্রবাসীরা যেসব দেশে র্কমরত সেসব দেশের স্থানীয় ব্যাংকগুলোর সাথে এ দেশের ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ড্রয়িং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স প্রেরণে উদ্বুদ্ধকরণ।দেশে রেমিটেন্সের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম র্শীষস্থানীয় প্রবাস আয় গ্রহীতা। বিবিএসের এক জরিপে দেখা যায় ২০১৫ সালে বাংলাদশের অভিবাসন সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো গড়ে ৩ লাখ ২ হাজার টাকার প্রবাসী আয় গ্রহণ করেছেন। এ জরিপের ফলাফলে আরো দেখা যায় প্রবাসী আয়ের প্রায় ২৫ শতাংশ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হয়।প্রবাসীদের বিনিয়োগে বিশেষভাবে উপকৃত হয় দেশের নির্মাণ খাত। তাছাড়া প্রবাসী আয় ভোগ ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমেও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা পালন করে।আশার কথা হলো, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০১৭ সালে প্রবাস আয়ের নিম্নমুখী ধারা থেকে বিশ্বের ঘুরে দাঁড়ানো এবং দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রক্ষেপন করছে।মুহিত বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের এ সকল উদ্যোগ এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ধারা আমাদের প্রবাস আয় প্রবাহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।