বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমান ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে তার মৃত্যু হয় বলে হাসপাতালের মহাব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম তুহিন জানান।বিচারপতি লতিফুর রহমানের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। স্ট্রোক হওয়ার পর দিন দশেক আগে তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিচারপতি লতিফুর রহমান ২০০০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ মাস বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।

১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষে তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন লতিফুর রহমান।তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার গঠন করে।ওই বছর ১০ অক্টোবর নতুন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন বিচারপতি লতিফুর রহমান। বর্তমানে সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা লতিফুর রহমানের ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমালোচনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত এপ্রিলেও এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন, ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জিততে দেওয়া হয়নি।

বিচারপতি লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে আলাদা বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।তারা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করেছেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের জানাজা সুপ্রিম কোর্টে অনুষ্ঠিত হয়েছে।জানাজায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী, কে এম হাসান, সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, মো. মোজাম্মেল হোসেন, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফ, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদার, সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি জয়নুল আবেদিন, সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ সিনিয়র আইনজীবীগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে আপিল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি মো. শামসুল হুদা বলেন, আজ বনানী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হবে।

লতিফুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচার কাজ মঙ্গলবার আধাবেলা বন্ধ রাখা হয়। বেলা পৌনে ২টার দিকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে জানাজা হয়।জানাজা শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান অত্যন্ত ভালো লোক ছিলেন। আমি আইনজীবী হিসেবেও তাকে পেয়েছি। তিনি সবসময় হাসিখুশি ছিলেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ছিলেন, আমরা সবাই মর্মাহত। তার দেওয়া এমন অনেক রায় আমরা এখনও অনুসরণ করি।জানাজায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী, কে এম হাসান, সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন ও মো. মোজাম্মেল হোসেন, সাবেক বিচারপতি ও সিইসি আব্দুর রউফ, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেন।

আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, এম আমীর-উল ইসলাম, আবদুল বাসেত মজুমদার, এ এফ হাসান আরিফ, এ জে মোহাম্মদ আলী, মাহবুবে আলম, জয়নুল আবেদীন, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মইনুল হোসেন, আবদুল মতিন খসরু, এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রমুখ।অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের জানাজায় অংশ নেন।জানাজা শেষে শ্যালক শামসুল হুদা সাংবাদিকদের জানান, বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে লতিফুর রহমানকে।

যশোর বারের আইনজীবী খান বাহাদুর লুৎফর রহমানের তৃতীয় সন্তান লতিফুর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১ মার্চ, যশোরে। তার মামা বিচারপতি নুরুল হুদাও এক সময় হাই কোর্টের বিচারক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর সেখানেই এল এল বি করেন লতিফুর রহমান।ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে চাকরি জীবন শুরু করলেও পরে ১৯৬০ সালে তিনি আইন পেশায় যোগ দেন। বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল এম এইচ খন্দকারের শিক্ষানবিশ ছিলেন তিনি।১৯৭৯ সালে বিচারক হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯১ সালে তিনি আপিল বিভাগে নিয়োগ পান।বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি অবসরে যান।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলি ও আমার কথা’ নামে একটি বইয়ে লতিফুর রহমান তার ৮৭ দিন সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতার কথা লিখে গেছেন। এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে লিখেছেন কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ’লতিফুর রহমানের স্ত্রীর নাম আয়েশা বেগম। শম্পা, রুম্পা ও নিপা তাদের তিন মেয়ে। মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বিচারপতি লতিফুর রহমান। বিচারপতি লতিফুর রহমান নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে ভুগছিলেন।১৯৭৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হন লতিফুর রহমান। ১৯৮১ সালে তিনি স্থায়ী বিচারপতি হন। ১৯৯১ সালে তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হন। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি। ২০০১ সালের ২৮ ফেব্র“য়ারি অবসর গ্রহণ করেন।