মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে যশোরের চৌগাছার ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ রেদওয়ানের (রহ.) মেলা। মেলা উপলক্ষে এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। চলবে ৭ দিন ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ বছর মেলা পরিচালনা কমিটি, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরিচালিত হবে মেলা। এজন্য নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যানকে সভাপতি এবং শিমুল হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাজরাখানা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মনিরুজ্জামান মিলন বলেন, ‘এবার মেলায় কাঠের আসবাবপত্র, খেলনা, প্রসাধনী, গার্মেন্টস, হোটেল-বেকারি, মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা, জাদু প্রদর্শনী, সার্কাস, স্টিল সামগ্রীসহ প্রায় হাজারের অধিক স্টল বসেছে। এবারে মেলার বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে কপোতাক্ষ নদে স্পিডবোট ও মৃত্যুকূপে প্রাইভেটকার চালানো।তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবকদল গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব, পুলিশ ও আনসার ভিডিপি সদস্যরা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করবেন।সূত্র জানায়, প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) এর রওজা শরিফকে ঘিরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে এই মেলা। জেলা প্রশাসন কাগজ কলমে সাত দিন অনুমতি দিলে সাধারনত মেলা চলে প্রায় ১৫ দিন। হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর এ অঞ্চলের কামেল পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) এর রওজা শরিফ অবস্থিত। মেলার সময় এলে আশপাশের গ্রামগুলোতে পড়ে যায় ব্যস্ততার ধুম। রেওয়াজ রয়েছে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলায় মেয়ে-জামাই আনার।

যাকে ঘিরে এই মেলা, তার সম্পর্কেও রয়েছে নানা মিথ। যা লোকমুখে প্রচার হচ্ছে বছরের পর বছর। কথিত হয়, পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তিনি যা বলতেন তাই হতো। তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুর্হূর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে তার জন্মকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। জ্যেষ্ঠ ভক্তদের মতে, তিনি ৩-৪ শ বছর আগে জন্ম গ্রহণ করেন।

বলুহ দেওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত কাহিনির একটি হলো, যখন তার বয়স ১০-১২ বছর, তখন বাবার আদেশে গ্রামের পাশের মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন তিনি। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেত মালিক গরুগুলো ধরতে গেলে তিনি সব গরুকে বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।বাবার মৃত্যুর পর বলুহ উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। বলা হয়, একদিন মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে তিনি সর্ষের গাদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখেন সর্ষেতে আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন সর্ষে পোড়েনি।একদিন মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুন জ্বাল দিতে থাকেন। এতে তার পায়ের কোনো ক্ষতি হয়নি। এমনি ধরনের হাজারো মিথ প্রচলিত রয়েছে পীর বলুহ দেওয়ানের নামে।এসব ‘অলৌকিক’ ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।তার মৃত্যুর পর এলাকার মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে পীরের নামে মানত করতে থাকে। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখান গ্রামে অবস্থিত তার রওজা শরিফে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, নারকেলসহ নানা দ্রব্যাদি ও টাকা দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। সেখান থেকেই একসময় এখানে আসা ভক্তদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ.) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে জমজমাট মেলা।

প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার এই শুরু হয়।এ বিষয়ে মেলা কমিটির সভাপতি ও নারায়ণপুর ইউপি চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন মুকুল জানান, প্রতিবার মেলা হয় সাতদিন। এবার চলবে দশ দিন (১২ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর)।একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত বিষয়। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে তৎকালীন সরকারি দল আশ্রিত সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানি ও দর্শনার্থী আহত হন। অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেলা চলাকালে চৌগাছা শহরে আওয়ামী লীগের অফিসে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা ও গুলিতে খুন হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ইমামুল হাসান টুটুল। যদিও এই ঘটনার সঙ্গে মেলার কোনো সম্পর্ক ছিল না।পরে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ায় বেশ কয়েক বছর ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মেলায় সারা দেশ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন নানা পসরা নিয়ে। এ অঞ্চলের যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ২০-৩০টি উপজেলার মানুষ আসেন মেলা দেখতে। তারা মেলা থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী কিনে নিয়ে যান। আয়তন ও পরিধিতে এটি সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলার সমতুল্য।এবারের মেলা উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের। এছাড়া বাড়তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ৪৭ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করা হয়েছে। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করবে। চৌগাছা থানার ওসি খন্দকার শামীম উদ্দিন বলেন, মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’উপজেলা নির্বাহী অফিসার নার্গিস পারভীন জানিয়েছেন, মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। মেলায় যেন কোনো প্রকার অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরি না হয় সে ব্যাপারে কঠোর দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।