ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের দিনক্ষণের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশে ফিরতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সে কারণেই সুষমার সফরের আগে তাঁর দেশে ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা।

আগামী ২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকা সফরের কথা রয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। যদিও সরকারিভাবে এখনো দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি। তবে বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রে প্রাপ্ত খবরে সফরের সম্ভাব্য ওই সময়ের কথাই জানা যায়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) চতুর্থ ওই বৈঠকে যোগ দিতে সুষমা ঢাকা আসবেন। দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এ ধরনের বৈঠক সাধারণত একবার দিল্লিতে হলে আরেকবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চেয়ারপারসন চিকিৎসা শেষ করে শিগগিরই দেশে ফিরবেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনার বিষয়ে তাঁরা বলেন, এখনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। দেখা যাক। লন্ডনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রও সুষমার সফরের আগে খালেদা জিয়ার দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে।বিএনপির সিনিয়র অন্য দুই নেতা অবশ্য জানিয়েছেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের সম্ভাব্য সাক্ষাতের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকেও যোগাযোগ রাখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি দেখা হবে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা এও বলেন, সুষমার সঙ্গে বৈঠকের দিনক্ষণ বা সময়সূচি নির্ধারণ হওয়ার পরই খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার সময় চূড়ান্ত হবে। গতকাল পর্যন্ত ওই দিনক্ষণ ঠিক হয়নি বলেও জানান তাঁরা। বলেন, ১৫ অক্টোবরের আগে বা পরে খুব সম্ভবত তিনি দেশে ফিরে আসবেন।

আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থায়ী কমিটির সিনিয়র আরেক সদস্য বলেন, খালেদা জিয়ার ঢাকা অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে সুষমা স্বরাজের দেখা না হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আবার এ নিয়ে অপরাজনীতি করবে। বলবে, বিএনপিকে ভারত গুরুত্ব দেয়নি। আমরা এ সুযোগ দিতে চাই না। তাই সুষমার সফরকে বিবেচনায় রেখেই খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার বিষয়টি নির্ধারিত হবে বলে জানান ওই নেতা।এর আগে ২০১৪ সালের জুন মাসে ঢাকা সফরের সময় সোনারগাঁও হোটেলে বৈঠক হয়েছিল খালেদা-সুষমার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের পায়ের চিকিৎসা এখনো শেষ হয়নি। ১২ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ নির্ধারিত রয়েছে। ওই চিকিৎসকের পরামর্শের ওপর তাঁর ফেরা-না ফেরার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থাকলেও দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আর দেরি না করে খালেদা জিয়ার ফেরা উচিত বলে বিএনপি নেতারা মনে করেন। তা ছাড়া আগামী নির্বাচন তথা রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে বলে মনে করে বিএনপি।

গত ১৫ জুন চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান খালেদা জিয়া। সেখানে চোখে অস্ত্রোপচারের পর এখন তাঁর পায়ের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় (প্রায় চার মাস) লন্ডনে থাকায় দলের ভেতরে-বাইরে এ নিয়ে এখন কিছুটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কেউ কেউ দেশের চলমান রাজনীতি ও বিভিন্ন ঘটনা-প্রবাহের সঙ্গে তাঁর লন্ডনে অবস্থানের যোগসূত্র মেলানোর চেষ্টা করছেন। সরকারি দল অনবরত বলে যাচ্ছে, লন্ডনে বসে খালেদা জিয়া ষড়যন্ত্র করছেন। ফলে সব কিছু মিলিয়ে তাঁর দেশে ফেরা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছেআড়াই মাসেরও বেশি সময় লন্ডনে অবস্থান শেষে আগামী সপ্তাহেই দেশে ফিরতে পারেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। দেশে ফিরেই তার নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করার কথা রয়েছে। এ ছাড়া তিনি দলকে চাঙ্গা করার জন্য ত্বরিত ফল লাভের জন্য আরো বেশকিছু ক্রাশ কর্মসূচিও ঘোষণা দিতে পারেন। আগে থেকেই লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামতের ভিত্তিতেই দলকে চাঙ্গা করার এসব কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।এদিকে দলের নেতারা জানিয়েছেন, তারা তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার নির্দিষ্ট তারিখটি সম্পর্কে অবহিত নন। তবে আগামী ১৫ অক্টোবরের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার দেশে ফেরার একটি সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) নেক্সট উইকেই (পরবর্তী সপ্তাহ) দেশে ফেরার কথা রয়েছে।খালেদা জিয়া কি আগামী ২০ অক্টোবরের মধ্যে দেশে ফিরবেন জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্দিষ্ট তারিখ তো বলতে পারব না। নেক্সট উইকে আসবেন। বেগম জিয়ার কি চিকিৎসা শেষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো শেষ হয়নি। তবে এরই মধ্যে শেষ হওয়ার আশা করছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিদেশ যাওয়ার প্রাক্কালে প্লেনের ভেতর থেকেই জানান, অক্টোবর মাসেই ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) দেশে ফেরার কথা রয়েছে। নির্দিষ্ট তারিখটি জানতে চাইলে তিনি বলেন,এর চেয় বেশি কিছু বলতে পারছি না।খালেদা জিয়া ১৫ জুলাই ফলোআপ চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। ৮ আগস্ট লন্ডনের মুরফিল্ড হাসপাতালে তার ডান চোখে অস্ত্রোপচার হয়। লন্ডনে তিনি তার পায়ের চিকিৎসাও করান। ৫ সেপ্টেম্বর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, পায়ের চিকিৎসা শেষ হলে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের ফিরবেন তার নেত্রী। তবে পায়ের চিকিৎসার জন্য তিনি সেই সময় আর দেশে ফিরতে পারেননি। লন্ডন বিএনপির সভাপতি এমএ মালেক তখন মানবকণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, হাঁটুর চিকিৎসার জন্য ম্যাডামের ১৫ তারিখ দেশে ফেরার সম্ভাব্য যে সিডিউল ছিল, তা পেছানো হয়।দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার চোখ ও পায়ের চিকিৎসা এখন প্রায় শেষ। আগের তুলনায় অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন। তাই তার দেশে ফেরার সময় হয়েছে। তা ছাড়া আগামী ২২ অক্টোবর ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন মূলত দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ পরামর্শমূলক কমিটির বৈঠকের জন্য। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পর্যালোচনা ছাড়াও আঞ্চলিক বিষয়ের মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যেই খালেদা জিয়ার সঙ্গে সুষমা স্বরাজের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকে যাতে তিনি উপস্থিত থাকতে পারেন সে জন্যই এর আগেই ঢাকায় ফিরতে পারেন খালেদা জিয়া।এ ব্যাপারে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল অবশ্য এখনই কিছু বলতে পারছেন না বলে জানান। তবে দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহসম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা মানবকণ্ঠকে জানান, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এলে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক তো হতেই পারে।খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে তিনি জানান, চলতি মাসের ১৫-২০ তারিখের মধ্যে তিনি ফিরতে পারেন। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে ম্যাডামের (খালেদা জিয়ার) সুস্থতার ওপর।লন্ডনে চিকিৎসার পাশাপাশি দীর্ঘ এ সময়ে কূটনৈতিক যোগাযোগসহ দলের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে বেগম জিয়ার। বিশেষ করে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলন ও সম্ভাব্য প্রার্থীর বিষয়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তিনি। সেখানে অবস্থান করেই দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন তিনি। দেশে ফিরে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখাও দেবেন। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথও খোলা রাখবেন তিনি।উল্লেখ্য, বিদেশে থাকলেও খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করে গেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি লন্ডনে থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ও ওআইসিভুক্ত দেশসহ মোট ৫০টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি দিয়েছিলেন। ১২ সেপ্টেম্বর একই দিনে এ চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা নির্ধারণের জন্য জাতিসংঘের অধীনে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা গঠন, প্রয়োজনে জাতিসংঘের অধীনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়াসহ ৫ দফার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। পুত্র তারেক রহমান ও পুত্রবধূ জোবায়দা রহমানের সঙ্গে একদিন লন্ডনের একটি শপিং মলে কেনাকাটা করা ছাড়া চিকিৎসার বাইরে আর কোথাও বের হননি খালেদা জিয়া। তিনি পূর্ব লন্ডনের কুইসস্টোন এলাকায় তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করছেন। বাসায় তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমান রয়েছেন। ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শামিলা রহমান, তার দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমানও আছেন সেখানে।সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর খালেদা লন্ডনে যান। সেবারও ছেলে, পূত্রবধূ ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ঈদ করেন তিনি।