মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত গণহত্যা ও সহিংসতার মধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর শুনানি করতে অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠকে বসছে।শুক্রবার (১৩ অক্টোবর) এই বৈঠক হবে বলে কূটনীতিকরা জানিয়েছেন। সেপ্টেম্বরের পর এটি পরিষদের দ্বিতীয় বৈঠক।এদিকে জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক শীর্ষ কর্মকর্তা জেফ্রি ফেল্টম্যান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে চারদিনের জন্য শুক্রবার মিয়ানমার সফরে যাচ্ছেন।জাতিসংঘ বলছে, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে মিয়ানমার। তারা এও বলেছে, রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি বিতাড়িত করতেই অভিযান চালাচ্ছে দেশটি।এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা জানান, জেফ্রি সংকট নিয়ে কথা বলবেন।এর আগে গত ২৯ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক হয়েছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ সাতটি রাষ্ট্র এই বৈঠকের আবেদন করে। বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরিসের বক্তব্য শুনেছেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। জবাবে চীন ও রাশিয়া তা উড়িয়ে দিয়ে মিয়ানমারেরই পক্ষ নেয়। কার্যত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় ‘বহুল কাঙ্কিত’ আলোচনা।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বলছে, সহিংসতার জেরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ ছাড়িয়েছে। দিন দিন রোহিঙ্গা ¯্রােত কোনো মতেই থামছে না। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। সহিংসতায় প্রাণ গেছে তিন হাজারের বেশি মানুষের। বেসরকারিভাবে এই সংখ্যা দশ হাজার পার করেছে মধ্য সেপ্টেম্বরেই। কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল সেখানে কাজ করার সুযোগ না পাওয়ায় নতুন তথ্য জানা যাচ্ছে না। এদিকে,রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আবারও নির্ভেজাল মিথ্যাচার করলেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। তার নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের তোলা রোহিঙ্গাবিরোধী ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের’ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে লাইং ধৃষ্ঠতা ও ঔদ্ধত্যের স্বরে বলেছেন, রোহিঙ্গা ‘পলায়নের’ যে খবর আসছে, তা অতিরঞ্জিত। আর রোহিঙ্গারাই ‘অবৈধ বাঙালি’।বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) মিয়ানমার সেনাপ্রধানের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে তার এ বক্তব্য উঠে আসে। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন জেনারেল হ্লাইং। রোহিঙ্গাবিরোধী নৃশংসতার বিষয়ে অনুশোচনার বদলে মিয়ানমারের কার্যত এ ‘সামরিক জান্তার’ স্বরে ছিলে ধৃষ্ঠতা। জেনারেল হ্লাইং দাবি করেন, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযান ছিল সমানুপাতিক। সেনাবাহিনীর তৎরতার ফলেই বরং শরণার্থী ঢল নিম্নমুখী ছিল।রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবেই পুনরায় আখ্যা দিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অনেক বেশি বলাটা অতিরঞ্জন। এই অতিরঞ্জন ও অপপ্রচার চালাচ্ছে গণমাধ্যম।অবৈধ অভিবাসী প্রমাণ করার জন্য এবং তাদের নাগরিক অধিকার বঞ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কৌশলগত কারণে দীর্ঘদিন ধরে ‘বাঙালি’ আখ্যা দিয়ে আসছে।এই কথাটিই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জেনারেল হ্লাইং বলেন, বাঙালিদের আদি-নিবাস হলো বাংলা (বাংলাদেশ)। সেজন্যই ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল আছে এবং নিরাপদবোধ করে- এমন কোনো দেশে তারা পালিয়ে থাকতে পারে।রোহিঙ্গারা ব্রিটিশ শাসনের অনেক আগে থেকেই রাখাইনের (তৎকালীন আরাকান) বাসিন্দা হলেও মিয়ানমার সেনাপ্রধানের দাবি, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের আদি-বাসিন্দা হলেও ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের রাখাইনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। মিয়ানমারে তাদের বংশ পরম্পরার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। বুধবারই (১১ অক্টোবর) প্রকাশিত জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শারীরিক, আবেগী ও মনস্তাত্ত্বিক ভয় ও মানসিক আঘাত গভীর ও বিস্তৃতভাবে গেঁথে দিতেই নৃশংসতার ভয়ানক কৌশল নিয়ে গত ২৫ আগস্ট থেকে অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।এতে আরও বলা হয়, ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর থেকে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে ৫ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনের এই অভিযানকে জাতিসংঘ আগে থেকেই ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ বললেও সেখানে কতোজনকে হত্যা করা হয়েছে, এ বিষয়ে এখনও স্পষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ভাষ্যমতে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। ধর্ষণ করেছে শত শত রোহিঙ্গা কিশোরী-তরুণী ও গৃহবধূকে।