বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুন:প্রবর্তক বলায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদাকে সতর্ক করল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।বুধবার (১৮ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে বসে দলটি তাকে সতর্ক করে। বেলা ১১টায় সংলাপের শুরুতেই সিইসি আওয়ামী লীগ ও এর নেতাদের অবদানের কথা তুলে ধরেন। বর্ণনা করেন জাতি পিতার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। এরপর ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বক্তব্য রাখেন।

সচিবের বক্ত্যবের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সংলাপের মূল আলোচনা। ওবায়দুল কাদের তার বক্তব্যের শুরুর দিকেই বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত অপশক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ রাতের আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্তব্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। কিছুদিনের মধ্যেই হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের হোতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের সংবিধান ও সকল প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেন, শুরু হয় স্বৈরশাসন।এরপর আওয়ামী লীগ নেতারা সংলাপে সিইসি’র উদ্দেশে বলেন, আপনার বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে। এগুলো মাথায় রেখে কথা বলবেন। সজাগ ও সতর্ক থাকবেন।তারা আরো বলেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার, ভুয়া খবর প্রচার করা হতে পারে।এসব বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করে আওয়ামী লীগ।গত ১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন। সেদিন সিইসি বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৩৯ বছর পূর্বে অত্যন্ত দৃঢতার সাথে ’৭৭ সালে বিএনপি গঠন করেন। সে দলে ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব মতাদর্শের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে একত্রতবে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিরোধিতার পাশাপাশি ভোটের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে দলটি।বুধবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে এই তিনটিসহ মোট ১১টি সুপারিশ করা হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে ২১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে এই আলোচনায় অংশ নেন। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। সোয়া দুই ঘণ্টার আলোচনা শেষে দলের পক্ষ থেকে দেওয়া সুপারিশগুলো সাংবাদিকদের জানান ওবায়দুল কাদের।ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছেন তিনি।

কাদের বলেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন এবং ইসি নির্ধারিত ভোটের পরবর্তী সময়ের জন্য প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ওপর ন্যস্ত থাকবে।আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার‌্যবিধির ১২৯ থেকে ১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালা ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে তার উল্লেখ রয়েছে।নতুন করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা নিয়ে জটিলতার শঙ্কাও করছে ক্ষমতাসীন দল।আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জানান, সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি বিশেষ করে আদমশুমারির সঙ্গে সম্পর্কিত। সর্বশেষ ২০১১ সালে আদমশুমারির (২০১৩ সালে প্রকাশিত) ওপর ভিত্তি করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের আগে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।তিনি বলেন, নতুন আদমশুমারি ছাড়া পুনরায় সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রম নিলে বিভিন্ন আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এ অবস্থায় ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের মতো জটিল কাজ শেষ করতে সময় স্বল্পতার কারণে সম্ভব হবে কিনা বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া অত্যাবশ্যক।২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্থানীয় সরকারের অনেকগুলো নির্বাচনের কথা বিবেচনায় নিয়ে ‘সবদিক ভেবে’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।অন্য সুপারিশগুলো হচ্ছে-ইংরেজিতে প্রণীত ‘দ্য রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার, ১৯৭২’ ও ‘দ্য ডিলিমিটেশন অব কন্সটিটিউয়েন্সিস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬’ এর বাংলা সংস্করণের সুপারিশ। নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নির্বাচনী আইন-বিধির কঠোর প্রয়োগ। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিতদের দায়িত্বে অবহেলা ও অপেশাদার আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসার নিয়োগ। দলীয় প্রার্থী চড়ূান্তে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে আগ্রহীদের বাছাই। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা বিধান। ভোটের দিন গণমাধ্যম কর্মীদের নির্বাচনী আইন-বিধি অনুসরণ এবং উপযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদান এবং দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের ভোটের তিনদিন আগে এনআইডি ও ছবিসহ তালিকা দেওয়া।

২০১৮ সালের শেষ দিকে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এমতাবস্থায় ৩০০ আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের মতো একটি জটিল কার্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে যেসব আইনানুগ পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে, তথা খসড়া থেকে আপিল নিষ্পত্তি পর্যন্ত যে মহা কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে হয়, আমরা ব্যাখ্যা পেয়েছি। কিন্তু বলবো না।’-বুধবার (১৮ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশন (ইসি) এর সঙ্গে সংলাপ সেরে বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে এ কথাটিই বললেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার এ বক্তব্য মূলত ইসির সঙ্গে সংলাপে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) দেওয়া বিতর্কিত বক্তব্যের জেরে আসা জিজ্ঞাসার জবাব।

গত ১৫ অক্টোবরের ওই সংলাপে সিইসি কেএম নূরুল হুদা বলেন, ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ৩৯ বছর পূর্বে ১৯৭৭ সালে অত্যন্ত দৃঢতার সাথে বিএনপি গঠন করেন। সে দলে ডান, বাম, মধ্যপন্থি সব মতাদর্শের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে একত্র করেন। তার মধ্য দিয়েই দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠা লাভ করে।সেদিনের বক্তব্যে বিএনপি আমলের উন্নয়নের প্রশংসাও করেন সিইসি। ওই বক্তব্যের জেরে পরদিন ইসিতে গিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি কাদের সিদ্দিকী সংলাপ বয়কট করে সিইসি’র পদত্যাগ দাবি করেন।ওই বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন-আমরা সংলাপে বসে সিইসি’র কাছে এর ব্যাখ্যা চাইব।বুধবার তাই স্বভাবতই ইসির সঙ্গে সংলাপ সেরে আওয়ামী লীগ নেতারা বেরিয়ে এলে সাংবাদিকরা তার ব্যাখ্যা চাওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু প্রথমবার প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে কেবল ব্যাখ্যা জানাতে অপারগতাই প্রকাশ করেন ওবায়দুল কাদের।কিন্তু সাংবাদিকরা তার ব্যাখ্যার চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আবারও প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সিইসি, অন্য নির্বাচন কমিশনার ও ইসি সচিব যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা ইউজফুল, পজিটিভ। আমরা ব্যাখ্যা পেয়েছি। কিন্তু বলতে চাই না।এ সময় ওবায়দুল কাদেরকে বেশ ফুরফরে মেজাজে দেখা যায়। এর আগে ‘সিইসি’র বক্তব্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল হতে পারে’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। দলটি একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ না করার এবং প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন না করাসহ এগারো দফা সুপারিশ করে।