মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ।তিনি জানান, ইউএনএইচসিআর, আইওএম, এমএসএফ ও রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সংস্থার মানবিক সহায়তায় রোহিঙ্গাদের বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মেজর ইকবাল বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে গত রোববার থেকে উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেয় অন্তত ১৫ থেকে ১৭ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের খাবার ও মানবিক সহায়তা দেওয়া হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় চারদিন ধরে শূন্যরেখার কাছাকাছিই রাখা হয়।

পরে বুধবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পাওয়ায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে শুকনো খাবার, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানি ও যাতায়তের ব্যবস্থাসহ নানা ধরণের মানবিক সহায়তা দিয়ে তাদের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হচ্ছে।তারআগে তাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে এবং তারা সঙ্গে করে কোনো ধরনের অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকসহ অবৈধ কোনো জিনিসপত্র বহন করছে কি না তাও তল্লাশি করা হচ্ছে বলে জানান বিজিবির এ কর্মকর্তা। গত সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন ৪২ বছর বয়সী আব্দুল গফুর। তিনি জানান, তার কিছু বড়লোক আত্মীয়-স্বজন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় ক্ষমতাবানদের টাকা দিয়ে এতদিন নিজেদের এলাকায় থেকে গিয়েছিলেন। তবে এখন আর টাকা দিয়েও লাভ হচ্ছে না। তাদেরও দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। তারা এখন বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।আব্দুল গফুর বলেন, সেখানে আমাদের দোতলা, তিনতলা পাকা বাড়ি রয়েছে। ভাইয়ের মেয়েদের সেনাবাহিনীর অত্যাচার থেকে বাঁচাতে তাদের নিয়ে বাংলাদেশে আগেই চলে আসেন গফুর। আর ভাইকে সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্বে রেখে আসেন। তবে এখন তার ভাইও পালিয়ে আসছেন।কেবল গফুর নন, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন আরও অনেক বিত্তশালী রোহিঙ্গা। সেখানে তাদের অনেকেরই প্রচুর জমি,অঢেল অর্থ, কারও কারও কারখানা, গাড়ির ওয়ার্কশপও রয়েছে। গত ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর নিজেদের বাড়িতে থেকে যেতে তারা সেনা সদস্য, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মোটা অংকের অর্থ ঢেলেছিলেন। তারপরও তাদের অধিকাংশেরই ব্যবসা লুট করা হয়েছে। এভাবে দুই মাস কোনোমতে পার করার পর নিজ ভিটা ছেড়ে শহরের দিকে গিয়ে সেখানেও আর থাকতে না পেরে বাংলাদেশই তাদের শেষ গন্তব্য হতে চলেছে।

আব্দুল গফুর বলেন,মিয়ানমারে আর থাকতে না পেরে আমার ভাই বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। জঙ্গল দিয়ে ঘুরে ঘুরে আসতে সময় লাগবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নিজ এলাকা ছেড়ে যে বিত্তশালীরা শহরের দিকে চলে গিয়েছিল, তারা আর না টিকতে পেরে বাংলাদেশের দিকে রওনা দিয়েছে।কেবল ভাইয়ের মেয়েদের সেনাসদস্যদের হাত থেকে বাঁচাতে আগেভাগে চলে আসা গফুর বলেন, গ্রামে এসে তারা রোজ তালিকা দিয়ে যে, কতজন নারী লাগবে তাদের। এরপর তারা তাদের তুলে নিয়ে যেত। যাদের তুলে নিয়ে যেত, তাদের খুব কমই ফেরত পাওয়া গেছে জানিয়ে গফুর বলেন, শরীর ছিন্নভিন্ন করে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

আজহুরুল হক (৪৪) রাখাইনের রাশিঢং এলাকা থেকে এসেছেন। স্ত্রী ও ৬ সন্তান নিয়ে পরিবারের সদস্য আটজন। তিনি বলেন, ‘এই ৬ জনের মধ্যে একটি আমার সন্তান। বাকিরা বোন ও ভাইয়ের সন্তান। আমি এসেছি কিন্তু ভাইয়ের পরিবার ব্যবসার কারণে আসেনি।’ আজহারুল বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা মোবাইল সেটের। পরিস্থিতি ঠিক হলে ফেরত যেতে পারি কিনা এটা ভেবে ব্যবসা ছেড়ে আসতে পারেনি ভাই। চলে আসার পর খবর পেয়েছি দোকানে হামলা হয়েছে। দোকানে আগুন দেয়নি কিন্তু মোবাইল সেট লুট করে নিয়ে গেছে।এলাকায় চেয়ারম্যান ছিলেন জোহার। এখন আছেন ক্যাম্পে একটা ছাপড়া ঘরে। নিজের বাড়ি, জমি, ক্ষমতা ছেড়ে শরণার্থী জীবনযাপন করতে হবে ভাবেননি কোনোদিন। জোহারের পরিবারের পোশাক দেখেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের থেকে আলাদা করা যায় তাদের। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বড়লোকেরা শহরের দিকে গিয়ে জীবন বাঁচাতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। এখন তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এদেশে ঢোকার পথ খুঁজছে। সবাই সব হারিয়েছে। কারোর কিছু নেই।জাতিসংঘের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত এবারের সহিংসতার শিকার পাঁচ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পালংখালী এলাকায় প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে আরও ১৫ হাজার।