দুই দিনের বৃষ্টিতে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টিতে নগরীর নিচু এলাকার অলি-গলিসহ কোনও কোনও এলাকার প্রধান সড়কেও পানি জমে গেছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শনিবার (২১ অক্টোবর) সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় নগরীতে ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সকাল থেকেই রাজপথে গণপরিবহনের উপস্থিতি ছিল কম। তবে শ্রমজীবী মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। তারাই বেশি দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।সকালে রাজধানীর মিরপুর এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে হাঁটু সমান পনি জমে যায়। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত সড়কটি পানিতে থৈ থৈ করছে। রোকেয়া সরণিতে পানি জমে গেছে। সড়কে গণপরিবহনের উপস্থিতি কম হওয়ায় অনেক মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে ফিরতে দেখা গেছে। কিছু কিছু স্থানে পানিতে আটকা পড়ে যানবাহন বিকল হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।নিম্নচাপের প্রভাবে টানা দুদিনের অবিরাম বৃষ্টিধারায় থমকে গেছে পুরো ঢাকা শহরের জনজীবন; মানুষের আনাগোনা নেই বেশিরভাগ রাস্তায়; যানবাহনের সংখ্যাও কম।বৃষ্টিতে পুরান ঢাকা থেকে শুরু পল্টন, মালিবাগ-মৌচাক ও রাজারবাগ এলাকা, মিরপুরের বিভিন্ন অংশ, বাড্ডা ও রামপুরা ও ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার প্রায় সব এলাকায় কমবেশি পানি জমেছে।পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজার, কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিমউদ্দিন রোড, মতিঝিল, বঙ্গভবনের দক্ষিণ ও পশ্চিমপাশের সড়ক, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে বেশি পানি জমেছে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ।সড়কের ম্যানহোল এবং নিষ্কাশন নালার পিটগুলো খুলে দেওয়ার কাজ করছে সিটি করপোরেশন।এ কাজে ডিএসসিসির ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’মাঠে রয়েছে বলে জানান ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা শফিকুল আলম।তিনি বলেন, ময়লা জমে ড্রেনের অনেক জায়গায় ব্লক হয়েছে। সেগুলো আমরা ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। চারদিকে আমাদের লোক নেমেছে। রাতেও তারা কাজ করেছে।সবখানেই পানি আছে। তবে আশার কথা হলো পানি যাচ্ছে। কোথাও স্লো, কোথাও ফাস্ট। কোথাও একবারে স্থবির হয়ে আছে এমন না।এদিকে মালিবাগের দিকে মালিবাগ, রাজারবাগ, মৌচাক, শান্তিবাগ, গুলবাগ, মোমিনবাগসহ বিভিন্ন অলি-গলির সড়কে পানির নিচে। কাকরাইলের নাইটিঙ্গল রেস্তোরাঁ থেকে পল্টন মডেল থানার সড়কেও পানি উঠেছে বিভিন্ন ফুটপাতে।মতিঝিলের বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী আবদুল হালিম কাকরাইল এলাকায় ছাতা নিয়ে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যানবাহনের অপেক্ষায়।তিনি বলেন, রামপুরা থেকে হেঁটে এসেছি। রিকশার ভাড়া অনেক বেশি। রামপুরা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেতে রিকশাওয়ালারা ১০০ টাকার নিচে যেতে চান না। তাই হাঁটা ছাড়া উপায় কী?হালিম জানান, মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার ভেতরের বেশ কয়েকটি গলির সড়ক পানিতে ডুবে গেছে।মালিবাগ থেকে মৌচাক পর্যন্ত ফুটপাতে সকাল থেকে হকাররা বসে। আজকে সকাল থেকে সেই ফুটপাত একেবারই ফাঁকা। চা বিক্রেতা হাকিম উদ্দিন বললেন, খুবই খারাপ দিন যাইতাছে। কালকেও বিক্রি নাই। আজকেও হবে বলে মনে হইতেছে না।অবিরাম বৃষ্টির কারণে মালিবাগ-মৌচাকের দোকান-পাটও সকালে খুলছে না।গুলবাগ, শান্তিবাগ, মোমিনবাগসহ এই এলাকায় ভেতরের রাস্তাগুলো পানির নিচে।

মানুষজনকে পানি ডিঙিয়ে বাইরে বের হতে হচ্ছে।সরেজমিনে বায়তুল মোকাররম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানকার ফুটপাতগুলোতে কাপড়-চোপড়ের পসরা নিয়ে দোকান বসলেও কোনো মানুষজন নেই।ফুটপাতে গেঞ্জি ও প্যান্টের বিক্রেতা ফজলুল হক বলেন, বৃষ্টির কারণে বিক্রি একেবারেই কম। গতকাল বিক্রি করেছি মাত্র ৫টা গেঞ্জি। কিভাবে দিন যাবে বুঝতে পারছি না।তিনি জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৪০/৪৫টি গেঞ্জি বিক্রি হয়।মালিবাগ, পল্টনের সড়ক পথের পাশের কয়েকটি হোটেলের কর্মচারীরা জানান, বৃষ্টির কারণে মানুষজন প্রায় আসছেই না।শনিবার স্কুল-কলেজ ও সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকলেও স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের কোচিং খোলা থাকে। মালিবাগ মোড় থেকে অনেক শিক্ষার্থী ফার্মগেইট এলাকায় কোচিং করতে যায়।যানবাহনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা এমন কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, বাসার সামনে পানি ডিঙিয়ে তাদের আসতে হয়েছে।উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী আফজাল উল হক ও রিফাত করীম বলেন, তারা ফার্মগেইটে কোচিং যাবেন। আধা ঘণ্টার বেশি দাঁড়িয়েও কোনো বাস পাচ্ছেন না। অথচ এই সড়কে সকালে প্রচুর যানবাহন পাওয়া যায়।বৃষ্টিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, শুক্রবাদ, ফার্মগেট ও ইন্দিরা রোডে এলাকায়ও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এসব এলাকার কোথাও কোথাও কোমরপানিও দেখা গেছে।মিরপুর ৬০ ফিট এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম মুনা বলেন, এখানে চতুর্দিকে পানি জমে গেছে। বাজার করতে মিরপুরে-১ নম্বরে যাওয়ার কথা থাকলেও বের হয়ে হাঁটুপানি দেখে ফিরে আসি।মিরপুরের ৬০ ফিট সড়ক অপেক্ষাকৃত উঁচু হলেও এতে পানি জমে যাওয়ার কথা জানান তিনি।রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, বাসাবো, যাত্রাবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায় বলে জানান এলাকাবাসীর অনেকে।মধ্য বাড্ডার বাসিন্দা ইশতিয়াক হাসান মতিঝিলে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে বলেন, বাসার সামনে কোমরসমান পানি। তা ডিঙিয়ে মেইনরোডে এসে দেখি গুলিস্তান রুটের বাস নেই। অফিস ধরতে হবে, অন্য রুটের বাস ধরে যাচ্ছি।

রামপুরা থেকে মাদারটেক, ত্রিমোহনী বা ডেমরাগামী যাত্রীরাও দুর্ভোগে পড়েন।সকাল সাড়ে ৮টার দিকে রামপুরা ব্রিজে অপেক্ষারত যাত্রী সোহেল মাহমুদ বলেন, ডেমরা রুটের বাস পাচ্ছি না। ৩০ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি।বনশ্রী থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনমুখী ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ বলেন, কমলাপুর আসার পথে দেখলাম মালিবাগের চৌধুরীপাড়া এলাকায় কোমর সমান পানি। খিলগাঁও ডিসিসি মার্কেট থেকে আবুল হোটেল মার্কেট পর্যন্ত আসার পথটি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোনো যানবাহন চলছে না। মালিবাগ রেলগেইটেও একই অবস্থা।এছাড়া যাত্রাবাড়ী, মাতুয়াইল, কাজলা ও ডেমরা এলাকার বিভিন্ন সড়কেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় ।এছাড়া বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্নস্থানের দুই পাশেই পানি জমে রয়েছে। অন্যদিনের তুলনায় এদিন এ সড়কে কম যানবাহন থাকলেও পানির কারণে দুপুর ১২টার দিকে আর্মি স্টেডিয়াম থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত যানজট দেখা গেছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর, মালিবাগ, পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড, খিলক্ষেতের প্রধান সড়কসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় একই চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় অলিগলিতে পানি জমে দোকানপাট ডুবে গেছে। ভাঙাচোরা রাস্তাগুলোয় যাত্রীদের দুর্ভোগ আরও বেশি। ঝুঁকি নিয়ে জলমগ্ন ভাঙা রাস্তায় চলতে হচ্ছে রিকশা-সিএনজিসহ ব্যক্তিগত যানবাহনগুলোকে।বনানী ১১ নম্বর এলাকা থেকে হোটেল র‌্যাডিসনের আগের ফ্লাইওভার পর্যন্ত সড়কেও এক হাঁটু পানি। উত্তরা যাওয়ার পথে থেমে থেমে পানির মধ্যে গাড়ি চলছে। উত্তরা থেকে ফেরার পথে রয়েছে যানজট। নৌবাহিনী সদর দফতরের সামনে এত পানি আগে কখনও দেখা যায়নি।সকালে ধানমন্ডির উদ্দেশে রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর বাসা থেকে বের হন ব্যবসায়ী রাশেদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ বৃষ্টি ও বাতাস তাতে বাসা থেকে বের হতেও ভয় হচ্ছে। বড় একজন পার্টনার অফিসে আসছেন, সে জন্যই বের হয়েছি। বাসার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু কোনও রিকশা, সিএনজি কিছুই পাচ্ছি না।

আগারগাঁও এর বাসিন্দা ও একটি জাতীয় দৈনিকের সংবাদকর্মী রহমত উল্যাহ বলেন, সকাল ১০টার পর তালতলা, আগারগাঁও,শেওড়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে ডুবে গেছে বলে খবর পেয়েছি। দুর্ভোগ এড়াতে প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। তবে যানজটও তেমন দেখা যায়নি। দুর্বল ড্রেনেজ সিস্টেমের কারণে পানি দ্রুত নামতে পারছে না। সিটি করপোরেশন বা ওয়াসার কোনও কর্মীকেও পানি সরানোর কাজে নামতে দেখা যাচ্ছে না।পান্থপথের একটি অফিসে চাকরি করেন সুলতানা বেগম। মিরপুর-১২ নম্বরে তার বাসা। তিনি বলেন, বাসা থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তাগুলো যেন নদী। বিকল্প পথ ব্যবহার করে অনেক অপেক্ষার পর একটি সিএনজি পেয়েছি। কিন্তু ভাড়া দ্বিগুণ দিতে হয়েছে। গতকালকের চেয়ে আজ (শনিবার) রাস্তায় পানি অনেক বেশি দেখা গেছে।মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন বলেন, সকাল থেকে ব্যাপক বাতাস। রাস্তাজুড়ে পানি। পানির কারণে বাসা থেকে বের হইনি।’এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, নগরীতে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে তিন নম্বর সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। তাই উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদে থাকতে বলা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গত দুই দিন ধরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে।নিম্নচাপের প্রভাবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ১-২ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছাসে প্লাবিত হতে পারে।এদিকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকাগুলোর জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অস্থায়ীভাবে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/ বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দমকা ঝড়ো হাওয়াসহ মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।

Image Courtesy : Sikder Naser Abu