ফাদার মারিনো রিগন ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারি খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসেন। কর্মসূত্রে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন সুন্দরবনের কাছে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে। আর দশজন ধর্মযাজকের মতো কেবল ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকেননি তিনি। নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, শিল্প, সংস্কৃতি আর শিক্ষামূলক বহুমাত্রিক কাজে। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের পরমবন্ধু।

ফাদার মারিনো রিগন মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধপীড়িত সাধারণ মানুষ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন দেশপ্রেমিক বাঙালির মতো।

১৯৭১ সালে ফাদার রিগন তখন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বানিয়ারচর গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের প্রধান ধর্মযাজক। ফাদার রিগন পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা, হত্যা-লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন, আর হানাদারদের অগ্নিসংযোগে পুড়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম নিজ চোখে দেখেছেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন চিকিৎসাসেবা। শুধু তাই নয়, যুদ্ধপীড়িতদের আশ্রয় ও খাদ্য সংস্থানের ব্যবস্থাও করেছিলেন। ফাদার রিগনের কাছেই চিকিৎসাসেবা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বৃহত্তম গেরিলা বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দিন।

 

মানবসেবা, সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রদান করেছে বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’। ফাদার রিগন রচিত মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মূল্যবান ইতিহাস। ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত ‘স্মারক সংগ্রহ’ অনুষ্ঠানে ফাদার রিগন তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের ডায়েরি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র’ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে দান করেন।

শরৎচন্দ্রের লেখা পড়েই বাংলাসাহিত্যে ফাদার মারিনো রিগনের প্রথম প্রবেশ। তারপর রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়। লোকায়ত বাংলার চারণ দার্শনিক লালনের প্রতি তিনি গভীর কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। লালন-গান তাকে সাধনার নতুন পথ দেখায়। ইতালিয়ান ভাষায় তিনি অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিসহ চল্লিশ কাব্য, জসীমউদদীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নির্বাচিত কবিতা, লালনের তিনশো পঞ্চাশটি গান ছাড়াও বাংলাদেশের অসংখ্য কবিতা। তিনি ইতালীয় রূপকথা পিনোকিও অনুবাদ করেছেন বাংলাভাষায়। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধা ফাদার মারিনো রিগন ইতালির ভিচেঞ্চায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ সময় রাত ১০টার দিকে জীবনের মায়াত্যাগ করে চলে যান। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ২০১৪ সাল থেকে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় বিশেষ যত্ন থাকার পর অবশেষে তিরানব্বই বছর বয়সে জীবনের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন এ মহান ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ হারালো তার পরমবন্ধুকে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হলো তা অপূরণীয়। তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।