ঘড়ির কাঁটায় দুপুর ৩টা। একটু পর পর থেমে থেমে বৃষ্টির দেখা মেলে। কাদা আর নোনাজলে সয়লাব চারদিক। হাঁটু সমান কাদা নিয়ে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণের অপেক্ষা, কখন আসবে সেই মুহূর্ত, হাতে পাবেন ত্রাণ, ফিরবেন শিশু সন্তানের কাছে। ত্রাণের দীর্ঘ লাইন পেরিয়ে সামনে এগোতেই পাহাড়ের চূড়ায় চোখে পড়ে ছোট্ট শিশুটি। পাহাড়ের চূড়ায় পলিথিন মোড়ানো টং ঘরে সমানে বৃষ্টিতে ভিজছে শিশুটি, অপেক্ষা মা ও খাবারের। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়, কিন্তু অপেক্ষা আর শেষ হয় না। এ চিত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘরে ঘরে। বলছিলাম উখিয়ার থ্যাংখালী ক্যাম্পের ৭ বছরের রোহিঙ্গা শিশু এনায়েতুর রহমানের কথা। সকাল থেকে ত্রাণের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যান মা তাসলিমা। ঘরে রেখে যান এনায়েতুর রহমানসহ আরও তিন শিশু সন্তানকে। সারাদিন চলে মা ও খাবারের জন্য এনায়েতুরের অপেক্ষা।

এদিকে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুরা পাচার, যৌন নিপীড়ন ও শিশুশ্রমের বিপজ্জনক ঝুঁকিতে দিন কাটাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সংগঠন সেইভ দ্য চিলড্রেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হেলে থরনিং স্কমিৎ।ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে রোহিঙ্গাদের ঠাসাঠাসি করে বাস, লেখাপড়ার অভাব ও ব্যাপক হতাশাসহ নানা কারণে এসব ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন সেইভ দ্য চিলড্রেনের সিইও।এদিকে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্বজুড়ে মিয়ানমারের সমালোচনা চললেও বেইজিং এখনো তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছে বলে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা গোয়া ইয়েঝা জানিয়েছেন।তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চীন রাখাইনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার নিন্দা জানায় এবং সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় মিয়ানমারের পদক্ষেপকে সমর্থন করে।

তাসলিমার বাড়ি রাখাইন রাজ্যে। প্রায় মাসখানেক আগে মিয়ানমার সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন স্বামী নূর আলম। সেনাদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে চার শিশু সন্তানসহ বাংলাদেশের থ্যাংখালী ক্যাম্পের ঘরে ঠাঁই হয়েছে বিধবা তাসলিমার।৬ বছরের এনায়েতুর যুগান্তরকে জানায়, মা সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন খাবার আনতে, এখন সন্ধ্যা হতে চলছে কিন্তু মায়ের দেখা মিলছে না। মা আর খাবারের অপেক্ষায় বসে আছে এনায়েতুর। সে আরও জানায়, জিয়া রহমান, নুরুল রহমান ও আজিজুর রহমান নামে তার আরও তিন ভাই রয়েছে। এনায়েতুর সবার বড়। তাকেই সবাইকে সারাদিন দেখভাল করতে হয়।এনায়েতুর জানায়, ছোট ভাইয়রা মা আর খাবারের অপেক্ষায় প্রায় প্রতিদিনই ক্ষুধা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। সে তাদের পাহারা দেয়। যেদিন মা খাবার নিয়ে ঘরে ফেরেন, ওই দিন তাদের খাওয়া চলে নয়তো উপোস থাকতে হয়।বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে কোমলমতি এনায়েতুর। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এনায়েতুর বলে, বাবা নেই, তাকে গুলি করে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা।এনায়েতুরদের পাশের ঘরেই দুই শিশুসন্তানসহ রয়েছেন রোহিঙ্গা নারী কমলা বেগম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এনায়েতুরের বাবাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শুধু তাসলিমা নয়, ত্রাণের জন্য সকালেই ঘর থেকে বেরিয়ে যান তাসলিমার মতো অন্য নারীরা। আর ক্যাম্পে আশ্রায় নেয়া অনেক শিশুই রয়েছে, যারা পিতৃহারা। তাই দিনের বেলায় তাদের দেখভালের কেউ থাকে না। আর খাবার আনতে আনতে বেশিরভাগ শিশু ক্ষুধা পেটে ঘুমিয়ে পড়ে।

মিয়ানমারের সেনা নির্যাতন থেকে প্রাণে বাচতে বাংলাদেশে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে লাখো রোহিঙ্গা। এদের অধিকাংশ নারী শিশু। কারণ বেশির ভাগ পুরুষের রয়ে গেছে অথবা তাদের হত্যা করা হয়েছে।সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৫ আগস্ট থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত অনাথ শিশুদের সংখ্যা ১৮ হাজার ২০৪ জন। এর মধ্যে বাব-মাহারা শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৩৯ শতাংশ। তারা এখন আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে।সমাজসেবা অধিদপ্তরের সিনিয়র সমাজসেবা অফিসার এমদাদ খান যুগান্তরকে বলেন, প্রতিনিয়ত অনাথ শিশুদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২৫ আগস্ট থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত অনাথ শিশুদের সংখ্যা ১৮ হাজার ২০৪ জন।প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইনে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনাক্যাম্পে হামলা চালায় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরএসএ)। ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যসহ ৮৯ জন মারা যায়। এর পরই রাজ্যটিতে শুরু হয় সেনা অভিযান।