মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা ও গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে পুনঃরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটি যে কোন দিন রায়ের (সিএভি) জন্য রাখা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের বিচারিক প্যানেল আজ এ আদেশ দেয়।এ মামলার প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ক এ কথা জানান। তিনি আসামীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পর্কে প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আসামীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভয়ংকর অপরাধ করেছে। তাদের স্থানীয় এলাকাকে নেতৃত্ব শূন্য করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ১৩ জন নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ (চেয়ারম্যান-মেম্বার) মোন ১৪ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করাসহ বিভিন্ন মানবতদাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছে। আসামীদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ সাজার রায় হবে বলে আশা প্রকাশ করেন এ প্রসিকিউটর।

তিনি বলেন, এর আগে গত ৯ মে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেল রায়ের জন্য মামলাটি অপেক্ষামাণ রেখেছিলেন। বিচারপতি আনোয়ারুল হক মৃত্যুবরণ করায় ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে গত ১১ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনরায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করে আদেশ দেয়। সে অনুযায়ী পুনরায় যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।

এ মামলাটি ট্রাইব্যুনালের ২৯তম মামলা যা রায় ঘোষণার পর্যায়ে রয়েছে। এর আগে আরো ২৮ মামলায় রায় ঘোষণা করেছে ট্রাইব্যুনাল। মামলার আসামীদের মধ্যে রয়েছেন-জামায়াতের সাবেক এমপি আবু সালেহ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে ঘোড়ামারা আজিজসহ ছয়জন। অন্যান্য আসামিরা হলেন- মো. রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু (৬১), মো. আব্দুল লতিফ (৬১), আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী (৫৯), মো. নাজমুল হুদা (৬০) ও মো. আব্দুর রহিম মিঞা (৬২)। এ ছয়জনের মধ্যে মো. আব্দুল লতিফ কারাগারে আছে, বাকী পাঁচজন পলাতক রয়েছে।আজিজসহ গাইবান্ধার ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর প্রসিকিউশনের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে ২৬ নভেম্বর ছয় আসামীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।আব্দুল আজিজ মিয়া ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পযর্ন্ত চার দলীয় জোটে জামায়াত থেকে গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ-১ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন। হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন, গুম, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের সুনির্দিস্ট অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ১৯৭১এর ৯ সেপ্টেম্বর সকাল অনুমানিক সাড়ে ৮ টার দিকে আসামীরা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ২৫/৩০ জনকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার সদর থানাধীন মৌজামালি বাড়ী গ্রামে হামলা চালায়। সেখানে ৪ জন নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের মানুষকে আটক, নির্যাতন ও অপহরন করে দাড়িয়াপুর ব্রীজে নিয়ে যায়। এর মধ্যে ব্রীজের কাছে গণেষ চন্দ্র বর্মন এর হাত পা মাথার সঙ্গে বেধে ব্রীজের নীচে নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করে এবং ৩ জনকে ছেড়ে দেয়। আসামীরা আটককৃতদের বাড়ীর মালামাল লুন্ঠন করে।অভিযোগ: ৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, বিকাল অনুমানিক ৪ টার দিকে আসামীরা গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানাধীন মাঠেরহাট ব্রীজ পাহারা দিতে থাকাবস্থায় ছাত্রলীগের নেতা মো. বয়েজ উদ্দিনকে আটক করে মাঠেরহাটের রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। পরের দিন সকালে আসামীরা আটককৃত বয়েজ উদ্দিনকে সুন্দরগঞ্জ থানা সদরের পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং ৩ দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন করার পর ১৩ সেপ্টেম্বর বিকালে গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দেয়।অভিযোগ-: ৭১ সালের ১০ সেপ্টম্বর হতে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আসামীরা পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানাধীন ৫টি ইউনিয়নের নিরীহ নিরস্ত্র স্বাধীনতার পক্ষের ১৩ জন চেয়ারম্যান ও মেম্বরকে অবৈধভাবে আটক করে। তাদেরকে ৩ দিন অমানুষিক নির্যাতন করার পর পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের কাছে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশগুলি মাটি চাপা দেয়। সেখানে বর্তমানে শহীদদের স্মৃতির জন্য একটি বধ্যভূমি নির্মিত হয়েছে।গত ১১ অক্টোবর বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামকে চেয়ারম্যান করে পুনর্গঠন করা হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। হাইকোর্টের বিচারপতি আমির হোসেন ও অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর সাবেক বিশেষ জজ মো. আবু আহমেদ জমাদারকে বিচারক প্যানেলের সদস্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির আদেশে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। নবগঠিত ট্রাইব্যুনাল ১২ অক্টোবর থেকে তার কার্যক্রম শুরু করে।