বিগত ৩০ বছর ধরে কট্টোর রক্ষণশীল সৌদি আরব স্বাভাবিক ছিল না এমন মন্তব্য করে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, দেশটিতে প্রচলিত ইসলামেও সংস্কার আনবেন তিনি। নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া আর বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়াতে বৈশ্বিক সমর্থন চান তিনি।

গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি রাজতন্ত্রের অন্যতম উত্তরাধিকারী সালমান এসব মন্তব্য করেছেন। বিগত ৩০ বছর সৌদি আরবের অস্বাভাবিক হয়ে উঠার কারণ হিসেবে তিনি ইরানি বিপ্লবকে দায়ী করেন। বলেন, এর নেতারা জানতেন না বিপ্লব পরবর্তী সমাজ কীভাবে পরিচালিত হবে। আর তার প্রভাব গিয়ে পড়ে সৌদি আরবের সমাজে।

বিনিয়োগকারীদের জন্য সৌদি আরব ৫০০ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প চালু করেছে। ওই প্রকল্পের আওতায় সৌদি আরব, জর্ডান আর মিসর সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় গড়ে তোলা হবে শিল্পাঞ্চল। সৌদি যুবরাজ সালমান বলেন, ‘আমরা জি-২০ ভুক্ত একটি দেশ। বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতি রয়েছে। তিন মহাদেশের মাঝখানে রয়েছি আমরা। সৌদি আরবে পরিবর্তন আসা মানে এই এলাকার সঙ্গে বিশ্ববাসীও তার সুফল ভোগ করবে। আর আমরা এখানে তাই করতে চাইছি। আশা করছি সকলে আমাদের প্রতি সমর্থন জানাবেন।’

তিনি বলেন, গত ৩০ বছরে যা ঘটেছে তা সৌদি আরব ছিল না। পুরো মধ্যপ্রাচ্যও এই সময়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। ১৯৭৯তে ইরানি বিপ্লবের পর মানুষ তা নকল করতে চেয়েছিল। আর সৌদি আরবও তাতে সায় দিয়েছিল। আমরা জানতাম না এটি কীভাবে মোকাবেলা করা হবে। ফলে সমস্যা ছড়িয়ে পড়ে পুরো পৃথিবীতে। আর এখন সময় এসেছে তা থেকে বের হয়ে আসার।

এর আগে সালমান বলেছিলেন, আমরা যা আছি তার বিপরীতে যেতে চাই। মধ্যপন্থী ইসলাম বিশ্বের আর সব ধর্মের জন্য খুলে দেবে। ৭০ শতাংশ সৌদি নাগরিকের বয়স ৩০ এর নিচে। কট্টোর চিন্তা করে আমরা আর সময় নষ্ট করতে চাই না। দ্রুতই তা শেষ করে এগিয়ে যেতে চাই।

সৌদি সমাজ সংস্কারে গত ছয় মাসে নেওয়া বিপুল পরিকল্পনার মধ্যে সৌদি যুবরাজের এসব মন্তব্য ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। বিনিয়োগকারীদেরও প্রনোদনা দিয়ে অর্থনীতিতে গতি আনতে চাইছে দেশটি। দেশটিতে প্রচলিত রাজতন্ত্র কট্টোর ইসলাম চর্চার কারণে সমালোচিত হয়ে আসছে।

সৌদি আরবের এসব সংস্কারকাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। রাজপরিবার থেকেও সমর্থন পাচ্ছেন তিনি। ১৫ বছরের জন্য নেওয়া সংস্কার প্রকল্পের প্রধান হিসেবে সৌদি কর্মকর্তাদের সমর্থনও পাচ্ছেনও তিনি।

এসব সংস্কার কাজের কেন্দ্রে রয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন। দীর্ঘদিনের নিরবতা ভেঙে সম্প্রতি নাীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে সৌদি সংস্কার। এছাড়া অভিভাবক পুরুষ ছাড়া নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়ার প্রচলিত বিধানেও পরিবর্তন আনছে দেশটি।

তবে রক্ষণশীল সামাজের প্রচণ্ড বাধার মুখে এসব পরিবর্তন সৌদি আরবের আধুনিক ইতিহাসে অভুতপূর্ব সাড়া ফেলবে। লোহিত সাগর উপকূলে ৪৭০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে তোলা নতুন অর্থনৈতিক এলাকা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক শহর দুবাইয়ের মতো সেখানেও নারী-পুরুষ পর্যটকেরা একসঙ্গে গোসলের অনুমতি পায়।

সৌদি আরবের অর্থনীতি মুলত তেলের উপর নির্ভরশীল। রাজতন্ত্র এখন তেলনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করতে চায়। তবে বাধাও রয়েছে, কাজের অনভিজ্ঞতা ছাড়াও দ্রুত পরিবর্তন হয়ে পড়া আবহাওয়াও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এই পরিকল্পনাকে। সৌদি আরবের এক শীর্ষ ব্যবসায়ী বলেন, ‘অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সঙ্গে সমানতালে সামাজিক সংস্কারও জরুরি। একটা ছাড়া অন্যটা অর্জন করা কঠিন। সামজিক সংস্কারে গতিই পরিবর্তনের চাবিকাঠি।’

মদ, সিনেমা, থিয়েটার এখনও সৌদি আরবে নিষিদ্ধ। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া নারী-পুরুষের একসঙ্গে চলাফেরাও দেখা হয় ভিন্ন দৃষ্টিতে। বিধি নিষেধ তুলে নেওয়ার আগে বিশেষ বাহিনী ধর্মীয় পুলিশ এসমস্ত গ্রেফতার করতে পারত। তবে এখন তাদের সেই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

সৌদি যুবরাজ সালমান বলেন, নাগরিক আর রাষ্ট্রের মধ্যে নতুন সামাজিক চুক্তি ছাড়া অর্থনৈতিক পুর্নগঠন ব্যর্থ হতে পারে। আগামী দশবছরে ৫ মিলিয়ন সৌদি নাগরিক কর্মক্ষম হবে। তাদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি দেশটির জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। নুতন অর্থনৈতিক এলাকা নির্মাণ ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হবে। বাতাস আর সৌরি শক্তিকে চলবে এই অর্থনৈতিক এলাকা। ওই এলাকা নির্মানে ব্যয় হওয়া বিপুল পরিমাণ টাকা রাজতন্ত্রের নিজস্ব হিসাব থেকেই মেটানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এখনই তাদের হাতে রয়েছে ২৩০ বিলিয়ন ডলার। আর বাকি কয়েকশো বিলিয়ন ডলার বিশ্বের অন্যতম তেল কোম্পানী আরামকোর ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।