প্রতিদিন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। তারা আসছেন এবার নির্যাতন নয়, ক্ষুধার জ্বালায়। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে ঢুকছে। সীমান্তের নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপের দক্ষিণপাড়া, জালিয়াপাড়া, ঘোলারচরসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। ওই পয়েন্টগুলোতে প্রশাসনের কড়াকড়ির ফলে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে মঙ্গলবার টেকনাফ ও উখিয়ায় পৃথক দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় ৫ শিশুসহ ৭ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশের প্রস্তাবের বিষয়ে কোনো জবাব না দিয়ে উল্টো এখন বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করছে মিয়ানমার। দেশটির নেত্রী অং সান সুচির একজন মুখপাত্র বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি কোটি ডলারের বিদেশি সহায়তা হাতে পাওয়ার আগে বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় কি না- সে বিষয়েই তাদের সন্দেহ রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের গ্রামে গ্রামে নির্বিচারে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মধ্যে গত ২৫ অগাস্ট থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের কারণে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে আছে গত কয়েক দশক ধরে। বাংলাদেশ বরাবরই বলে আসছে, মানবিক কারণে আপাতত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া হলেও তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ সমস্যার পেছনে বাংলাদেশের কোনো ভূমিকা নেই; সমস্যার সৃষ্টি ও কেন্দ্রবিন্দু মিয়ানমারে, সমাধানও সেখানে নিহিত।রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সু চির দপ্তরের মহা পরিচালক জ তাই মঙ্গলবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে তিনি বলেন, মিয়ানমার ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে প্রস্তুত আছে, সে কথা আগেই জানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি।আমরা শুরু করতে চাই। কিন্তু অন্য পক্ষ তো এখনও সাড়া দিচ্ছে না। ফলে দেরি হয়ে যাচ্ছে।আর বুধবার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্থ বাংলাদেশে আসার বিষয়টি টেনেছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ৪০ কোটি ডলার পেয়েছে। তারা যেভাবে টাকা পাচ্ছে, তাতে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আরও বিলম্বিত হবে বলে আমাদের আশঙ্কা। আমাদের মনে হচ্ছে, তারা হয়ত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে নতুন কিছু ভাবতে পারে।রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর জন্য অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় দুই দেশের বৈঠকে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্র“প’ গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারে যান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। সেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে কফি আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।রয়টার্স জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার গত বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে; সেখানে বলা হয়েছে, ওই দশ দফা প্রস্তাবের বিষয়ে মিয়ানমার এখনও সম্মতি দেয়নি।মিয়ানমার বলে আসছে, রোহিঙ্গাদের পরিচয় এবং তাদের মিয়ানমারে বসবাসের তথ্য যাচাই হলেই তাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তাই বলেছেন, তার দেশ এখন বাংলাদেশের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের তালিকার জন্য অপেক্ষা করছে।

১৯৯২ সালে মিয়ানমারের সামরিক সরকার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছিল, তার আওতায় দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে সে সময় ফিরিয়ে নিয়েছিল তারা। চুক্তি নির্ধারিত যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও ২৪১৫ জন শরণার্থীকে ‘মিয়ানমার থেকে আসা’ বলে চিহ্নিত করা হলেও তাদের আর তারা ফিরিয়ে নেয়নি।গত অগাস্টে রাখাইনে নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচনার মধ্যে মিয়ানমারের তরফ থেকে বলা হয়, ১৯৯২ সালের চুক্তির আওতায় ‘যাচাইয়ের মাধ্যমে’ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রাখাইনের মুসলমানদের ফিরিয়ে নিতে তারা প্রস্তুত।এর ধারাবাহিকতায় সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে অক্টোবরের শুরুতে ঢাকায় এলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই দেশ একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্র“প’ গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়।১৯৯২ সালের চুক্তি এখন আর ‘বাস্তবসম্মত নয়’ জানিয়ে ওই বৈঠকে নতুন একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এগিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে মিয়ানমারের জবাব এখনও বাংলাদেশ পায়নি।গত ৯ অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, যে প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের চুক্তির নীতিমালা ও যাচাইয়ের প্রক্রিয়াগুলো ঠিক করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি তার তুলনায় অনেকটাই আলাদা। সুতরাং ওই চুক্তি অনুসারে এবার রোহিঙ্গাদের পরিচয় শনাক্ত করার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়।১৯৯২ সালের ওই চুক্তির চতুর্থ দফায় রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়, যাদের কাছে মিয়ানমারের জাতীয় পরিচয়পত্র বা জাতীয় নিবন্ধন কার্ড থাকবে, অথবা যারা জাতীয়তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য মিয়ানমার সরকারের যে কোনো দপ্তরের দেওয়া কোনো নথি দেখাতে পারবে এবং যারা মিয়ানমারে তাদের বসবাসের প্রমাণ দিতে পারবে- তাদের সবাইকে ধাপে ধাপে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। কিন্তু গত মাসে কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আসা একজন কূটনীতিক বলেছেন, যে অবস্থায় এই মানুষগুলো মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে, তাতে তাদের কাছে পরিচয়পত্র আশা করা কঠিন।তাছাড়া রোহিঙ্গাদের কাছে জাতীয় পরিচিতির যেসব কাগজপত্র ছিল, গতবছরই সেগুলো বাতিল করে দিয়েছে মিয়ানমার। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন গত ২৬ অক্টোবর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইংকে ফোন করে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন কোনো শর্ত না দিয়ে ১৯৯২ সালের প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন তিনি।এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক পরদিন বলেন, হ্যাঁ, এখনকার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। তবে আমরা মনে করি, ১৯৯২ সালের সমঝোতা যে প্রিন্সিপাল মেনে হয়েছিল, তাকে ভিত্তি ধরে এবারও আলোচনা এগিয়ে নেওয়া যায়।তার ওই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও পরে বলেন, ১৯৯২ সালের চুক্তির সঙ্গে নতুন বিষয় যোগ করে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা ভাবতে পারে।

বেঁচে যাওয়া জাবেদ নামে এক রোহিঙ্গা জানান, মিয়ানমার সীমান্তের দমংখালী থেকে রাতের বেলায় এক
নৌকায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৩০-৩৫ জন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পাড়ি জমায়। প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে রাত ১২টার দিকে টেকনাফ উপকূলে পৌঁছে। মহেশখালিয়াপাড়ার সৈকত পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে কূলে ভেড়ার সময় বড় ঢেউয়ের কবলে পড়লে নৌকাডুবির এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নৌকায় থাকা রোহিঙ্গারা সাঁতরে কূলে উঠলেও দুই শিশুর মৃত্যু ঘটে এবং এক শিশু নিখোঁজ রয়েছে। এ ঘটনায় কয়েক শিশুর অবস্থা বেগতিক হলে টেকনাফ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।বুচিডংয়ের রহিমা নামে এক রোহিঙ্গা নারী জানান, মিয়ানমারের সীমান্তের ধংখালীর বালুচরে নৌকার জন্য অপেক্ষায় থেকে এক মাস একদিন পর এপারে আসতে পেরেছে। সেখানে আরো শত শত রোহিঙ্গা তাঁবু গেড়ে নৌকার অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি আরো জানান, খাদ্যের অভাবে তারা এপারে আসছেন। তার স্বামীও তাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেছে জানে না। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ২ ছেলেকে নিয়ে তাদের পিছু নিয়ে দেশত্যাগ করেছে। এপারে এসে কূলে ভেড়ার সময় ঢেউয়ের কবলে পড়ে নৌকা থেকে ছিটকে তার এক ভাইপোর ছেলের মৃত্যু হয়েছে ও তার এক ছেলেকে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে বলেছেন, মিয়ানমারে নির্যাতন এখনো কমেনি। তারা নির্যাতনের ধরন ও কৌশল পাল্টেছে মাত্র। পালিয়ে আসা বেশিরভাগ রোহিঙ্গা রাখাইনের বুচিডং ও রাছিডং থানার বাসিন্দা।মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, সে দেশে সেনাবাহীনির নির্যাতন অনেকটা কমে আসলেও তারা ঘরের মধ্যে এক প্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। ঘরের মধ্যে যে সব খাদ্যসামগ্রী রয়েছে তাও ফুরিয়ে গেছে। কাজের সন্ধানে অথবা খাদ্য সংগ্রহ করতে বাইরে গেলে তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। সবকিছু কেড়ে নেয়ার পরও চলে নির্যাতন। জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো বিদেশি সংস্থাকে ত্রাণ দিতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার। তাই তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে রাখাইনে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে। তা ছাড়া রোহিঙ্গাদের উৎপাদিত ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী। খাদ্য সংকটের কারণে মূলত রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।অন্যান্য সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এখন বন্ধ থাকলেও টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। মঙ্গলবারও এক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। টেকনাফ সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানান, গত এক সপ্তাহে শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট দিয়ে পনেরো হাজার নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।টেকনাফ সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান মিয়া জানান, রাতে একটি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ২ শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে স্থানীয়রা এবং আরো ৫ জন নিখোঁজ রয়েছে বলেও শুনেছেন তিনি।বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মাওলানা আজিজ উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি বাহারছড়ার উপকূল দিয়ে অনুপ্রবেশকালে কোস্টগার্ড বাধা দেয়। কোস্টগার্ডের ধাওয়া খেয়ে রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটি ইনানীর দিকে চলে যায়। বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কাঞ্চন শামলাপুর পয়েন্ট থেকে ৩ রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধারের সতত্য নিশ্চিত করেছেন।উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনের লাশ উদ্ধার ও ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। আরো ছয়জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২৯ আগস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাবাহী ২৮টি নৌকাডুবির ঘটনায় প্রায় ২শ’ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।