শাড়ীর আচলা দিয়া ঢাকি আকিয়াও মোর স্বামীক বাঁচবার পাং নাই। মেলেটারী টানি হেচরী মোর চোখের সামনত স্বামী ও মোর ৬ দেবরক গুলি করি মারি ফ্যালাইল। হেই কথা বলতে গেলে এখন ও গাঁওত কাঁটা দেয়। বাড়ীঘর জমি জমা সউগ নদী ভাঙ্গি নিয়ে গেইল তাও অত কষ্ট পাং নাই। কিন্তু ওই দিনের ঘটনা আজকেও ভুলবার পারং নাই। এ কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা ছকিনা বেওয়া। মেয়ের বাড়ীতে আশ্রীত থেকে ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে তার। অভাব অনটনে দিশেহারা ছকিনার খোজ কেউ রাখে না। ছকিনার মত আর বেশ কয়েকজন শহীদ বিধবা ভিক্ষা করে দিন যাপন করছে দীর্ঘকাল থেকে।

জানা গেছে,কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামে ১৯৭১ সালে ১৩ নভেম্বর ২৩ রমজান সেহেরীর পর ঘুমন্ত নিরিহ মানুষের উপর বরবর নির্যাতন ও গনহত্যা চালিয়ে ৭ শত নর নারী ও শিশুকে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। শহীদ পরিবার গুলো কেউ স্বামী,কেউ সন্তান,কেউ পিতা,কেউ বা স্বজন হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ সময় শহীদ পরিবারের শতাধিক গৃহবধু স্বামী হারিয়ে বিধবা হন। অনেকে স্বজন হারা শোকে পাগল হয়ে মারা যায়। শহীদ পরিবার গুলোর শোকের ছায়া কাটতে না কাটতে ব্রম্মপুত্র নদীর ভাঙ্গনে দাগারকুঠি বদ্ধভুমি,হাতিয়া গ্রাম,হাতিয়া ভবেশ, নয়াডারা,অনন্তপুর, জলেংগার কুঠি সহ ওই ১৫টি গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। বিলিন হয়ে যায় শহীদ পরিবার গুলোর বাড়ীঘর। হারিয়ে যায় তাদের স্বপ্ন ও ঠিকানা। ভুমিহীন হয়ে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। অনেক পরিবারের আশ্রয় হয় বাঁধের রাস্তায়। সব হারিয়ে এ সব পরিবার অভাব অনটনে দুর্বিসহ দিন যাপন করছে। এদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারী সহায়তা। আর তাই শহীদ পরিবারের অনেক বিধবার জীবন কাটে ভিক্ষা বৃত্তি করে। এদের খোজ খবর কেউ রাখে না। ৭১-র গনহত্যায় অনন্তপুর কুড়ার পাড় গ্রামের ছকিনা বেওয়ার স্বামী আব্দুল কাদের ও তার ৬ ভাইকে পাক বাহিনী হত্যা করে। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় বিধবা হন ছকিনা বেওয়া। স্বজন হারানো শোক কাটতে না কাটতে বাড়ীঘর নদীর ভাঙ্গনে শিকার হয়। পরে ছেলে মেয়েকে নিয়ে হাতিয়া বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নেয়। সে আশ্রয়টুকু ভেঙ্গে গেলে মেয়ের বাড়ীতে আশ্রীত থেকে ভিক্ষা করে জীবন যাপন করছেন বলে জানান তিনি। ছকিনার মত ঘ্যাগেরটারী গ্রামের শহীদ আলিমুদ্দিনের বিধবা স্ত্রী ময়জন বিবি(৭৫),বাঁধ রাস্তাবাসি জুলেখা বেওয়া(৮০) ও কচভান বেওয়া(৭৮) ২ যুগ ধরে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এদের কারে বাড়ী ভিটা বা ঘরবাড়ী নাই। অন্যের বাড়ীতে আশ্রীত থাকেন বলে জানালেন। হাতিয়া ইউনিয়নের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মিজানুর রহমান জানান রংপুর বিভাগের সর্ববৃহৎ হাতিয়া গনহত্যা দাগারকুঠি বদ্ধভুমি সরকারী ভাবে এখন ও কোন স্বীকৃতি পায়নি। শহীদ ও শহীদ পরিবারের তালিকা করা ও তাদের পুর্নবাসন করা হয়নি। আর তাই শহীদ পরিবার গুলো অবহেলিত বলে জানান।হাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন জানান,শহীদ পরিবারের সঠিক তালিকা না থাকায় কে শহীদ, কে নয়,তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। ফলে তাদের সহায়তা প্রদান করা সম্ভব হয় নাই। তারপর ও অনেককে পুর্নবাসন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জানান,শহীদ পরিবার গুলোর তালিকা প্রনয়নের জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয়েছে ইতিমধ্যে কিছু তালিকা পাওয়া গেছে। সকল শহীদদের নাম স্বৃতিস্তম্ভে সংরক্ষন করার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়া যারা বাস্থহারা তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।