কক্সবাজার শহর থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার থাইংখালী-২ ত্রাণশিবির। এই শিবিরের একপাশে খোলা মাঠে তাঁবু টানিয়ে চলছে রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনকেন্দ্র। সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রের সামনে তিনটি পৃথক লাইনে দাঁড়িয়েছিল নারী, পুরুষ ও শিশুরা। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ছিল তখন প্রায় ১০০ জন। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছিল লাইন। বেলা ১১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় এই কেন্দ্রে নিবন্ধন হয় ৭২৩ রোহিঙ্গার।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিবন্ধন কার্ড গলায় ঝুলিয়ে ত্রাণশিবিরের দিকে যাচ্ছিল কয়েকটি রোহিঙ্গা শিশু। তাদের একজন সলিম উল্লাহ (৮)। সকাল আটটায় লাইনে দাঁড়ায় সে। পরিচয়পত্র (নিবন্ধন কার্ড) পেয়ে খুব খুশি সে। নিবন্ধন কার্ডের ওপরের অংশে লেখা ‘মিয়ানমার ন্যাশনালস রেজিস্ট্রেশন কার্ড’। এর নিচে কার্ডের নম্বর, নাম, ছবি, দেশের নাম, জন্মস্থান, বয়স, লিঙ্গ, বাবা ও মায়ের নাম রয়েছে।এই কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বালুখালী কাশেমিয়া উচ্চবিদ্যালয়। এখানে স্থাপন করা হয়েছে বালুখালী-১ নিবন্ধনকেন্দ্র। এর তত্ত্বাবধায়ক ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের কাজ চলে। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় এখানে প্রায় দেড় হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন করা হয়। রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শুরু হয় গত ১১ সেপ্টেম্বর রাতে। সেদিন ১০ রোহিঙ্গার নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। গতকাল ১১ নভেম্বর পর্যন্ত ২ মাসে ৪ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে।উখিয়ার ত্রাণশিবিরে স্থাপিত তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মিডিয়া সেন্টার’-এর কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, সব মিলিয়ে গত দুই মাসে ৪ লাখ ৮২ হাজার ১১৮ রোহিঙ্গা নিবন্ধনের আওতায় এসেছে।কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা এসেছে। তারা উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী ত্রাণশিবিরে অবস্থান করছে।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করছে। এতে সহযোগিতা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে যুক্ত রয়েছে বলে এর আগে একাধিকবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ।কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, সাতটি কেন্দ্রে দিনে গড়ে ১০ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গার নিবন্ধন হচ্ছে। তিন মাসের মধ্যে সব রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে তাঁরা আশা করছেন।এদিকে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় মানবিক সাহায্যের চেয়েও এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন বাংলাদেশের আর মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেই সংকট সমাধান সম্ভবÑবলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে করণীয় ঠিক করতে শনিবার রাজধানীতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি আয়োজিত গোল টেবিল আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন।পররাষ্ট্র সচিব বলেন, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় এখন দরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক সহযোগিতা। এ সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে এরই মধ্যে একটি চুক্তির খসড়াও সরকার তৈরি করেছে।তিনি আরো বলেন, ‘মানবিক সহযোগিতার চেয়েও এখন বড় হয়ে দাড়িয়েছে রাজনৈতিক সহযোগীতা।আন্তর্জাতিক সহযোগীতা নিয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশকেই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কীভাবে সমস্যা সমাধান করা যায়, সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্চ।‘এ সময় সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামাজিকভাবেও মানবপাচার, পতিতাবৃত্তি, মাদকের ব্যবসার নজির পাওয়া যাচ্ছে। বন ধ্বংস হচ্ছে, পর্যটক হারাচ্ছে। অপরাধ বাড়ছে। এসমস্যার দ্রুত সমাধান দরকার। এরজন্য জোড়ালো কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আঞ্চলিক জোটকে কাজে লাগাতে হবে।আর আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলেন,রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিকভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করতে পারে বাংলাদেশ।তারা আরো বলেন, বাংলাদেশকে বোঝাতে হবে যে, রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের একার নয়। উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলোকে বোঝাতে বড় আকারের সেমিনার করা যেতে পারে। সরকারকে বেসরকারি সংস্থা, বিশেষজ্ঞদেরও পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত কীভাবে সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে সরকারকে নানামূখী উদ্যোগ অব্যাহত রাখা এবং তৎপড়তা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন আলোচকরা।এদিকে, গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে পলিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কারনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজার এলাকার অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয় সংস্থাটির লিখিত বক্তব্যে।সেখানে আরো বলা হয়, স্থানীয়দের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আয় কমে যাওয়া, পর্যটন কমে যাওয়া এমনকি নিরাপত্তাও এরই মধ্যে বিঘিœত হচ্ছে।