প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। মঙ্গলবার সকালে তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন বলে জানায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয় সূত্র।সূত্র আরো জানায়, সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র মঙ্গলবারই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন মঙ্গলবার বলেন, পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আজ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে এক মাসের বেশি ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর বিদেশে যান বিচারপতি সিনহা। সেই ছুটি শেষে গত শনিবার তার পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা জানায় বঙ্গভবন।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। বয়স অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে ৮১ দিন আগেই তার কার্যকাল শেষ হয়।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২১ জন বিচারক প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই প্রথম পদত্যাগ করলেন। দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশে আর কোনো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে প্রকাশ্যে এত আলোচনা-সমালোচনাও হয়নি।বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।সর্বোচ্চ আদালত জানায়, ওই সব অভিযোগের ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ তিনি না দিতে পারায় সহকর্মীরা তার সঙ্গে এজলাসে বসতে নারাজ।গত অক্টোবরে বিচারপতি সিনহা ছুটিতে যাওয়ার পর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার দেন রাষ্ট্রপ্রধান মো. আবদুল হামিদ।

আর বিচারপতি সিনহা পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতি এখন সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে গত শনিবার জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাহার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের মত আইনমন্ত্রী আনিসুলক হকও ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, যতদিন নতুন প্রধান বিচারপতি শপথ না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের কর্তৃত্ব আবদুল ওয়াহহাব মিঞার হাতেই থাকছে। এর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডা যাওয়ার পথে গত শুক্রবার (১০ নভেম্বর) সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতিকালে শুক্রবার হাইকমিশনে পদত্যাগপত্র পৌছে দেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।কার্যত ছুটি নিয়ে বিদেশ সফরে থাকা সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার ছুটির শেষ দিনই পদত্যাগ পত্র জমা দেন। ১০ নভেম্বরই তার ছুটি শেষ হয়। গত ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। সেখানে তিনি বড় মেয়ে সূচনা সিনহার বাসায় ওঠেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান গত সোমবার। সেখান থেকে তিনি কানাডায় তার ছোট মেয়ে আশা সিনহা’র কাছে যান। এর আগে গত ২ অক্টোবর এক মাস ছুটির কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বরাবর চিঠি পাঠান প্রধান বিচারপতি। ওই ছুটির মেয়াদ ছিল ১ নভেম্বর পর্যন্ত। পরে তিনি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে থাকার ইচ্ছা পোষণ করে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেন।এর ধারাবাহিকতায় গত ১২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপনও জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। আগামী ৩১ জানুয়ারি ছিলো প্রধান বিচারপতি হিসেবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র শেষ কার্যদিবস। কিন্তু গত ১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংক্ষুব্ধ হয়। বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। তাঁরা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন।সংসদে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তাঁর এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের সংশোধনী বাতিল করেছেন।এক পর্যায়ে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আপিল বিভাগের অন্য সব বিচারপতি তার সঙ্গে বসতে অনিহা প্রকাশ করেন। এমন পরিস্থিতিতে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশে না ফিরে তার ছুটির শেষ দিন পদত্যাগপত্র পাঠান।