স্বাধীনতার ৪৬ বছর। আজও অবহেলিত কপিলমুনি গৌরবগাঁথা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ইতিহাস। ভুলতে বসেছে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম কপিলমুনি যুদ্ধের ইতিহাস। আজও সম্পন্ন হয়নি বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ, সংরক্ষণ করা হয়নি যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়ীত স্থাপনা ও স্থানগুলো। একে এক নিচিহ্ন হচ্ছে স্মৃতিচিহ্নগুলো। এলাকাবাসী আশাহত হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকার দীর্ঘসময় রাষ্টীয় ক্ষমতায় রেথকেও কপিলমুনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিলিন হতে বসেছে।
৯ ডিসেম্বর ১৯৭১। এদিন খুলনার পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি পাক হায়েনা ও তাদের দোসরদের কবল থেকে মুক্ত হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে তথা ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কপিলমুনির ভূমিকা অনস্বীকার্য। কপিলমুনি ছিল রাজাকারদের দুর্গ এবং শক্তিশালী ঘাঁটি। এ ঘাঁটির মাধ্যমে কপিলমুনি, তালা, ডুমুরিয়াসহ খুলনা ও সাতক্ষীরার বিশাল অংশ রাজাকাররা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। খুলনার ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যিক নগরী বিনোদগঞ্জ প্রতিষ্ঠাতা রায় সাহেব বিনোদ বিহারীর বাড়িটি ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। প্রায় ২০০ রাজাকার ও মিলিশিয়ার ছিল সশস্ত্র অবস্থান। সুবিশাল দোতলা ভবন, চারদিকে উঁচু প্রাচীর অনেকটা মোগল আমলের দুর্গের মতো। সুরক্ষিত দুর্গে বসে চলতো তাদের অত্যাচার। জোর করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি আনা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। এলাকাটিতে হিন্দুদের বসবাস বেশি থাকায় তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন, ধন-সম্পদ লুট এমনকি জোর করে তাদের অনেককেই ধর্মান্তরিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। হত্যা করা হয় শত শত মানুষকে। লালসার শিকার হন অগণিত মা-বোন। তাদের নির্যাতনের মাত্রা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, আজো সে দিনের ঘটনা বর্ণনা দিতে গিয়ে অনেকেই গা শিহরে ওঠেন। মানুষ ধরে দেয়ালে পেরেক দিয়ে শরীর গেঁথে রাখা হতো। হাত-পা কেটে ছিটানো হতো লবণ। এমনকি বড় বড় ইট দিয়ে শরীরে আঘাত করে হত্যা করা হতো। নির্যাতন করে হত্যার পর গোপন সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে লাশ পাশের কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়া হতো। এক পর্যায়ে তাদের অত্যাচারে এলাকার মানুষের জান-প্রাণ হয়ে ওঠে ওষ্ঠাগত। এ অবস্থায় মুক্তিবাহিনী ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই কপিলমুনিতে প্রথম আক্রমণ চালায়। আরেকবার তালা থানার নকশালদের সমবেত চেষ্টায় রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করা হয়। কিন্তু পর পর ২টি আক্রমণ আশানুরূপ ফল না হওয়ায় রাজাকারদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই শত্র“ মনে করে যে কোনো লোককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করতো। কপিলমুনির এ শক্ত রাজাকার দুর্গ আক্রমণের জন্য তৈরি করা হয় মহাপরিকল্পনা। দীর্ঘ চিন্তাভাবনা ও খোঁজখবরের পর কপিলমুনি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের সুনিপুণ পরিকল্পনা ও সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে রাজাকাররা হাত উঁচু করে অস্ত্র ক্যাম্পে রেখে লাইন দিয়ে সহচরী বিদ্যা মন্দির মাঠে আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার ঘাঁটি পতনের খবর পেয়ে মুহূর্তের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা আর এলাকার মানুষে পুরো মাঠ পরিপূর্ণ হয়। নির্যাতিত ও স্বজনহারা মানুষ এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে চড়াও হয় রাজাকারদের ওপর। যে যেভাবে পেরেছিল আক্রমণ করেছিল রাজাকারদের ওপর। পরে রাজাকার ক্যাম্প থেকে ব্যবহৃত অস্ত্র আনতে গিয়ে উদ্ধার হয় দেয়ালে পেরেক গাঁথা লাশ। মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর সন্দেহে ধরে এনে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। জানা যায়, পেরেকবিদ্ধ ব্যক্তির নাম সৈয়দ আলী গাজী, পিতা রহিম বক্স গাজী, বাড়ি তালা থানার মাছিয়াড়া গ্রামে। এ খবর স্কুলের মাঠে পৌঁছলে হাজার হাজার উত্তেজিত জনগণ তাদের (রাজাকার) মেরে ফেলার দাবি করে। জনগণের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক যুদ্ধকালীন কমান্ডাররা ৯ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় ১৫১ রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করেন। বাস্তবায়িত হয় গণআদালতের রায়। যা ছিল বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধকালীন ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী অধ্যায়।
কপিলমুনি গুণিজন সংসদের সভাপতি আঃ সবুর আল-আমিন ফোকাস বাংলাকে জানান, কপিলমুনি মুক্তদিবস পালন করা হয় না বলেও চলে। তবে এবার কপিলমুনি আঞ্চলিক মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি মুক্ত দিবসে র‌্যালী করে বলে জানাগেছে। এদিকে ২০১৩ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শুরু হলেও অর্থাভাবে মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী কপোতাক্ষ নদ খননের নামে গত বছর অর্ধনির্মীত স্মৃতিস্থম্ভ ধ্বংস করা হয়। অর্ধনির্মীত বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ উপর প্রতিদিন বসছে মাছের হাট। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগের সদস্য সচিব মোঃ রশীদুজ্জামান ফোকাস বাংলাকে জানান, সে সময় বরাদ্দ না থাকায় এবং ক্ষমতার পালা বদলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য ১৯৭১ এর ৬ ডিসেম্বর জাতীয় লোক সভায় ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্দী দীর্ঘ ভাষণ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এর ৩ দিন পর অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর কপিলমুনি মুক্ত হয়।