দুর্নীতিবাজরা যতোই ক্ষমতাশালী হোক না কেন আগামী বছর থেকে তালিকা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।শনিবার আন্তর্জাতিক দুর্নীতি প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমি কার্যালয়ে কিশোর তরুণদের জন্য দুদক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ কথা বলেন তিনি।
জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ নিয়ে কাউকেই আর দুর্নীতি করার সুযোগ দেয়া হবে না বলেও জানান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। দেশের উন্নয়নে দুর্নীতিকে অন্যতম বড় বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ বাধা দূর করতে আগামী বছর থেকে কমিশন আরো কঠোর পদক্ষেপ নেবে।দুর্নীতিবাজদের কারণে তাদের পরিবারের সদস্যরা যাতে সমস্যায় না পড়ে সে বিষয়েও নজর দেবে দুদক। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ উপহার দিতে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে সবাইকে সোচ্চার ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।দুর্নীতিকে এক ধরনের নেশা আখ্যায়িত করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, টাকা যারা উপার্জন করে- তারা কিন্তু ভোগ করতে পারে না। দুর্নীতিবাজরা এই ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। দুর্নীতি করে যে টাকা- যে সম্পদ তারা জমায়, তা তারা ভোগ করতে পারে না। শরীর স্বাস্থ্যের কারণে পারে না, বয়সের কারণেও পারে না।তাদের সম্পূর্ণ কাজটা হচ্ছে একেবারেই একটা নেশা। টাকার নেশা এবং ক্ষমতার নেশা। তাদের এই দুই নেশার কারণে আজকে আমরা দেখছি ব্যাংক লুট, সরকারি কাজে ঘুষ, ব্যবসায় অনিময়, প্রশ্নপত্র ফাঁস…, কোথায় নেই দুর্নীতিবাজরা? এক কথায় তাদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
দুর্নীতিবাজ নির্মূলে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমরা আমাদের দেশ, আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারি না। দুর্নীতিবাজ নামের এই শকুনদের আমরা উৎখাত করতে চাই। যারা দুর্নীতি করছে তাদেরকে আমরা দাঁতভাঙা জবাব দিতে চাই।এই কাজ একা দুর্নীতি দমন কমিশনে পক্ষে করা সম্ভব নয়, কমিশন অনুঘটকের কাজ করবে। আমাদের আহ্বান থাকবে, সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি- অন্তত নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি দুর্নীতিমুক্ত সুন্দর সমাজ উপহার দেওয়ার জন্য যার যার জায়গা থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হোন, সোচ্চার হোন।আলোচনায় অংশ নিয়ে অর্থের পেছনে না ছুটে জ্ঞান অর্জন ও নিজেকে যোগ্য করে তোলাকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে নতুন প্রজন্মকে আহ্বান জানান লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল।তরুণদের উদ্দেশে জাফর ইকবাল বলেন, আমাদের জীবনটা কত বড় বলো… ছোটো এতটুকু একটা জীবন। আমাকে যদি আনন্দ পেতে হয় তাহলে স্বাভাবিক হচ্ছে…, আমি যদি দুর্নীতিবাজ হই, অসৎ হই, আমার জীবনে কোনো আনন্দ নাই। আয়নার সামনে দাঁড়াও, দেখো নিজেকে, তোমার মন বলবে- একটা চোর দাঁড়িয়ে আছে। তখন কেমন লাগবে বলো?আজকে এইখান থেকে এক লাখ টাকা চুরি করেছি, অমুক যায়গা থেকে ১০ কোটি টাকা চুরি করেছি… জীবনে কোনো আনন্দ আছে? নাই। জীবনটাকে আনন্দময় করতে হবে। আমি যদি জীবনে আনন্দ পেতে চাই, সুখী হতে চাই তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে- আমি অনেস্ট থাকব, অন্যায় করব না, অন্যকে অন্যায় করতে দেব না, অন্যের জন্য স্বার্থহীন ভাবে কিছু করব।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, যারা দুর্নীতিবাজ মানুষ, তারা অনেক টাকা উপার্জন করে; এত টাকার কি দরকার আছে, বলো? একজন মনুষকে যদি খুবই সুখে-শান্তিতে থাকতে হয় তাহলে কত টাকা লাগে? কোটি টাকা তো লাগে না।অনেকে ভাবে আমাকে অনেক টাকা উপার্জন করতে হবে- নইলে জীবনে কিছু হবে না। সে টাকা উপার্জন করার জন্য দুর্নীতি করে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে- দুর্নীতি পরিহার করতে হবে।এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি ও নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা শোনান লেখক জাফর ইকবাল।তিনি বলেন, আমাদের বাংলাদেশ এখন অনেক উন্নত হয়েছে। আমরা যারা ১৯৭১ দেখেছি, আমাদের মনে আছে-দেশ যখন স্বাধীন হলো, কোথাও কিছু নাই। আমরা যারা বেঁচে ছিলাম, আমাদের যে ট্রেনিং হয়েছে, পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ সেই ট্রেনিং পায় নাই।আমাদের মাত্র একটা শার্ট ছিল, আমরা তিন ভাই ভাগাভাগি করে সেই শার্ট পরতাম। বড়ভাই হুমায়ুন আহমেদ বাইরে কোনো কাজ থাকলে সে শার্টটি পরে যেত। সে ফিরে আসলে আমি সেই শার্ট পরে বের হতাম। আমরা এই জীবন কাটিয়েছি। কিন্তু আমি যে কষ্ট করেছি, এই দেশের অনেক মানুষ আমার চেয়ে বেশি কষ্ট করেছে; জীবন তো এগিয়ে গেছে।অধ্যাপনা ও লেখালেখির পাশাপাশি সামাজিক নানা কর্মকা-ে জড়িত জাফর ইকবাল বলেন, আমি বই লিখি, কবিতা লিখি, গান শুনি, গান গাই, পড়ি, চিন্তা করি…, কতরকম সফিস্টিকেটেড কাজ আছে। আমি তো মানুষ, আমার তো জন্ম হয় নাই টাকা রোজগার করে সেই টাকার উপর বসে থাকার জন্য। তোমাদের টাকার পেছনে ঘুরতে হবে না.. দেখবে- তোমরা যদি ভালো হও, যোগ্য হও তাহলে তোমার পেছনে টাকা ঘুরবে।টাকার চেয়ে জ্ঞান অনেক মূল্যবান সম্পদ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ২০০০ সালে যখন নতুন মিলেনিয়াম শুরু হয়েছে, তখন পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন- এই সহ¯্রাব্দের মূল সম্পদ হচ্ছে জ্ঞান। মানিব্যাগের দরকার নাই, মাথার ভেতরে জ্ঞান আছে কী না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।বুদ্ধিমান ও চৌকস মানুষেরা পৃথিবীতে অসম্ভব মূল্যবান মন্তব্য করে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, আমরা তো কাজকর্ম করি, নানা কাজে নানারকম লোকের প্রয়োজন হয়; আমরা দেখেছি, কাজকর্ম করতে পারে, অনেক কিছু জানে, চৌকস, যে কোনো সমস্যা সমাধান করতে পারে- এ রকম মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না, অল্প।কাজেই যারা কাজকর্ম করতে পারে, মাথায় জ্ঞান আছে, বুদ্ধি আছে, সমস্যা সমাধান করতে পারে, তারা অসম্ভব মূল্যবান এই পৃথিবীতে। কাজেই আমি কেন খামাখা টাকার পেছনে ঘুরব? আমি জ্ঞানের পেছনে ঘুরব, নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলব।আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে দুদক কমিশনার নাসিরউদ্দিন আহমেদ, কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম এবং দুদক সচিব শামসুল আরেফিন উপস্থিত ছিলেন।