অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধির বহু আলোচিত গেজেটটি প্রকাশ হয়েছে। সোমবার (১১ ডিসেম্বর) জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, শৃঙ্খলাবিধির প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে। সেটি এখন বিজি প্রেসে ছাপা হচ্ছে। একইসঙ্গে গেজেটের কপিও হাতে পাওয়া যাবে।তিনি বলেন, শৃঙ্খলা বিধির গেজেটে হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে প্রকাশ শুরু হয়ে গেছে। এই বিধিমালায় আপত্তি জানিয়ে তা ফেরত পাঠিয়েছিলেন পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।তার ঘটনাবহুল পদত্যাগের পর দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে আইনমন্ত্রীর আলোচনার পর বিধিমালা চূড়ান্ত হয়।
আনিসুল হক বলেন, মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হচ্ছে। তাদের সাথে একটা ঐকমত্যে পৌছে এই শৃঙ্খলা বিধির গেজেট আজ প্রকাশ করা হচ্ছে।বিচারপতি এস কে সিনহা এই বিধিমালা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে দাবি করেন আইনমন্ত্রী।এই শৃঙ্খলা বিধি নিয়ে অনেক নাটক হয়েছিল। আমি আজ আপনাদের বলব, বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।একজন ব্যক্তি এটাকে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টার কারণে এটা বিলম্বিত হয়েছিল। সেটা যখনই রিমুভড হয়ে হয়ে গেছে, আমরা কিন্তু বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের ঐকমত্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিতে আজকে গেজেট করতে পেরেছি।
মাসদার হোসেন মামলার চূড়ান্ত শুনানি করে ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেয়।ওই রায়ে আপিল বিভাগ বিসিএস (বিচার) ক্যাডারকে সংবিধান পরিপন্থি ও বাতিল ঘোষণা করে। একইসঙ্গে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার জন্য সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয় সর্বোচ্চ আদালত।মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পর ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে বিচার বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার একটি খসড়া প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।সরকারের খসড়াটি ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার অনুরূপ হওয়ায় তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থি বলে গতবছর ২৮ আগাস্ট শুনানিতে জানায় আপিল বিভাগ।এরপর ওই খসড়া সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্ট আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। সেইসঙ্গে তা চূড়ান্ত করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে উপস্থাপন করতে বলা হয় আইন মন্ত্রণালয়কে।এরপর দফায় দফায় সময় দেওয়া হলেও সরকারের সঙ্গে আদালতের মতপার্থক্যের কারণে ওই বিধিমালা গেজেট প্রকাশের বিষয়টি ঝুলে থাকে।আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এর আগে শৃঙ্খলা বিধিমালার যে খসড়া সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া হয়েছিল, গত ৩০ জুলাই তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তখনকার প্রধান বিচারপতি সিনহা।শৃঙ্খলাবিধির সেই খসড়া নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে গত ১৩ অক্টোবর দেশ ছাড়ার পর ছুটি শেষে ১০ নভেম্বর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন।এরপর গত ১৬ নভেম্বর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার সঙ্গে বৈঠক করে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ওই খসড়া নিয়ে মতপার্থক্য দূর হয়েছে।এরপর তিনি সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন প্রমোটিং ইকোয়ালিটি, জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আসার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে গেজেট প্রকাশের তথ্য জানান।আনিসুল হক বলেন, “কিছু কিছু প্রতিকূলতা আছে। এই প্রতিকূলতাগুলো কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। একটু সময় হলে আমি মনে করি অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পারব।নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। তিনি কখন নিয়োগ দেবেন, সেটা তো তিনি আমাকে বলবেন না।আইনমন্ত্রী একইসঙ্গে বলেন, অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি সংবিধান অনুসারে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ সব কাজই করতে পারেন।তিনি বিচারপতি নিয়োগ দিলেও সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ লংঘন করা হয় না।এর আগে রবিবার (১০ ডিসেম্বর) বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেট প্রকাশে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে ওই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে বিচারকদের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণসংক্রান্ত বিধিমালা না করায় গত একবছর ধরে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপড়েন চলে আসছে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকার ২৫ দফা সময় নিয়েছে।গত শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বিধিমালা নিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘শৃঙ্খলা বিধিটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে (বৃহস্পতিবার) চলে গেছে বলে আমি জানি। আশা করছি, আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে এ গেজেট প্রকাশ হবে।এর আগে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।গত বছরের ২৮ আগস্ট এই মামলার শুনানিতে আপিল বিভাগ জানান, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ, যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী। এরপরই সুপ্রিম কোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। একইসঙ্গে ওই বছরের ৬ নভেম্বরের মধ্যে তা প্রণয়ন করে প্রতিবেদন আকারে আদালতকে অবহিত করতে নির্দেশ দেয়।১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে বিচারিক আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল। ১২ দফার মধ্যে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বাস্তবায়ন করেছে সরকার।২০১৫ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগ চার সপ্তাহ সময় দেন সরকারকে। এরপর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একটি খসড়া শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়। কিন্তু তা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠন করে আলাদা একটি শৃঙ্খলাবিধি তৈরি করেন।