বিগত চার বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে আসছিল একটি প্রেসের কর্মচারী। এ বছরের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও সে ফাঁস করেছে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর ইন্দিরা রোডের একটি প্রেসের কর্মচারী খান বাহাদুরকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ।গত ১৩ অক্টোবর ঢাবি ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।পরীক্ষা শেষে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল পাওয়া যায়। এ নিয়ে ওইদিনই ঢাবিতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে ভর্তি পরীক্ষা! শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। তবে বরাবরই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি বলে দাবি করে আসছিলেন ঢাবির ভিসি অধ্যাপক ড. মো.আখতারুজ্জামান। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি উঠে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু এসব দাবির কোনও তোয়াক্কা না করে তড়িঘড়ি ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় এবং উত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করা হয়।

সিআইডি কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বর জামালপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় সাইফুল ইসলামকে। তার দেওয়া তথ্য মতে বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) গ্রেফতার করা হয় প্রেসের কর্মচারী খান বাহাদুরকে। যে প্রেসে সে কাজ করতো সেখানে ঢাবির ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ছাপানো হয় এবং তার মাধ্যমে প্রেস থেকে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

নজরুল ইসলাম জানান, এর আগে ১১ ডিসেম্বর নাটোর ও পাবনা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা রকিবুল হাসান ইসামীকে এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকা অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। খান বাহাদুরের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল সাইফুলের। আর সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় ছিল রকিবুল হাসানের। খান বাহাদুরের প্রেসে প্রশ্নপত্র ছাপার বিষয়টি জানতে পারে সাইফুল।সে পরে বিষয়টি রকিবুল হাসানকে জানায়। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বাড়তি আয়ের বিষয়টি প্রথমে মাথায় আসে রকিবুলের। সে অনুযায়ী সাইফুলকে প্রেন কর্মচারী খান বাহাদুরের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে বলে রকিবুল। এরপরই প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, সাইফুল ইসলাম, রকিবুল হাসানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্র।সিআইডি’র দেওয়া তথ্যমতে, গত ২০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মহীউদ্দিন রানা ও আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা দুজন ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির জন্য পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও ডিভাইস সরবরাহ করতো। তাদের দেওয়া তথ্যে গত ১ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশরাক হোসেন রাফি ও ফারজাদ সোবহান নাফিকে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার হয় আনিন চৌধুরীকে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে আরও দুটি নাম জানতে পারে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। ১৪ নভেম্বর রংপুর থেকে নাভিদ আনজুম তনয় ও এনামুল হক আকাশকে গ্রেফতার করা হয়। নাভিদ ও এনামুল গ্রেফতারের পর কারা কারা জালিয়াতি করে ভর্তি হয়েছে, তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া সাত শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়। আটক শিক্ষার্থীরা হলেন- নাহিদ ইফতেখার, রিফাত হোসেন, মো. বায়েজিদ, ফারদিন আহম্মেদ সাব্বির, তানভি আহম্মেদ মল্লিক, প্রসেনজিৎ দাস ও মো. আজিজুল হাকিম। পরবর্তীতে একই অভিযোগে গ্রেফতার করা হন তানভির হাসনাইন, সুজাউর রহমান সাম্য, রাফসান করিম ও মো. আখিনুর রহমান অনিক।উল্লিখিতদের গ্রেফতারের পর সিআইডি জানতে পারে, এই চক্রটি শুধুমাত্র ডিভাইস সাপ্লাইয়ের সঙ্গে জড়িত এমন নয়। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গেও জড়িত। গ্রেফতার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য মতে, গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর জিগাতলা থেকে গ্রেফতার করা হয় নাজমুল হাসান নাঈমকে। পরবর্তীতে ৯ ডিসেম্বর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বনি ইসরাইল ও রাজশাহীর বিনোদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় মো. মারুফ হোসেনকে।এই বনি ও মারুফ দুজনই ভর্তি জালিয়াতির জন্য ছাত্র সংগ্রহ এবং রকিবুল হাসান ইসামীকে ছাত্রদের তথ্য সরবরাহ করতো। রকিবুল হাসান নাটোর ও পাবনা জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা। তাকে ১১ ডিসেম্বর গ্রেফতার করে সিআইডি।রকিবুল গ্রেফতারের পর কোথা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় সে বিষয়ে সিআইডি জানতে পারে বলে জানান অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রকিবুলের দেওয়া তথ্যমতে, ১৩ ডিসেম্বর জামালপুর থেকে গ্রেফতার করা হয় সাইফুল ইসলামকে। সে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল থেকে পাস করে বিভিন্ন কাজ করতো। সাইফুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রেস কর্মচারীর তথ্য পাওয়া যায়। প্রেস কর্মচারীর নাম খান বাহাদুর। সে ইন্দিরা রোডের একটি প্রেসে ২০১০ সাল থেকে কাজ করছে। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে বিগত চার বছর ধরে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খান বাহাদুরকে গ্রেফতার করা হয়।প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ করা সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, এই খান বাহাদুরই মূলত প্রশ্নপত্র ফাঁস করতো। তার হাত দিয়েই প্রশ্নপত্র অন্যদের কাছে পৌঁছাতো। এই চক্রে জড়িত অন্যরা সদস্য সংগ্রহ ও ডিভাইস সরবরাহসহ অন্যান্য কাজগুলো করে আসছিল।সর্বশেষ প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুরকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই চক্রের প্রায় সব সদস্যকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে বলে জানান সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করা একটি সামাজিক ব্যাধি। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জালিয়াতি করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকার ঘটনা সামাজিক ব্যাধি থেকে সামাজিক অবক্ষয়ে রূপ নিয়েছে। যারা এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিচ্ছে তারাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যালে ভালো ভালো বিষয়ে পড়াশুনা করছে। আর তারাই যদি পরবর্তীতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আসনে উপনীত হয়, তাহলে রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।