বাংলাদেশে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে। এ ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎসও চিহ্নিত করেছে দুদক। এসব হল- ‘শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ সরকারি প্রেস (বিজি প্রেস), ট্রেজারি ও পরীক্ষা কেন্দ্রের অসাধু কর্মকর্তা। এদের সঙ্গে যুক্ত কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র থাকতে পারে বলেও জানিয়েছে দুদক। শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত দুদকের ‘শিক্ষাসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’-এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়, পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কিশোরদের প্রথম পরিচয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে সেখানে তাদের পরিচয় হচ্ছে পঙ্কিল দুর্নীতির সঙ্গে। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস দুর্নীতির নতুন সংযোজন। অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কতিপয় দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা এজাতীয় অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দুদক পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে গঠিত দুই সদস্যের শিক্ষাসংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিমের অপর সদস্য ছিলেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমান। বুধবার সকালে কমিশনে তারা প্রতিবেদন উপস্থাপন করলে বিকালে এটি অনুমোদন দেয়া হয়।

এর পর পরই দুদক সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট বা গাইড, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে স্বচ্ছতা, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ ও বদলিসহ শিক্ষা খাতে নানা ধরনের দুর্নীতির উৎস বন্ধের জন্য সুনির্দিষ্ট ৩৯টি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর পাঠিয়ে দেন। প্রশ্নফাঁসে সরকারি কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণের প্রতিটি স্থানেই দায়িত্বে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অর্থের বিনিময়ে সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক প্রশ্নপত্র ফাঁস অপরাধমূলক অসদাচরণ, যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের তফসিলভুক্ত অপরাধ।

‘এ ছাড়া সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলে প্রমাণিত উৎকৃষ্ট অনুশীলন অনুকরণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সাধনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর।’ ‘তবে এসব অপরাধ দমনে দালিলিক প্রমাণাদি পাওয়া কষ্টকর। এজাতীয় দুর্নীতি দমনের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম’ বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে প্রতিবেদনে ৮ দফা সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, এ প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও বিতরণে যারা থাকবেন, তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকারনামা নিতে হবে যে, তাদের সন্তান কিংবা পোষ্যসংশ্লিষ্ট কেউ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন না। অর্থাৎ স্বার্থের দ্বন্দ্ব যেন না থাকে। এ অঙ্গীকারনামা যাচাই করে তাদের মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে। প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত মডারেটরসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারিতে রাখা যেতে পারে। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে মেধাবী, সৎ এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষক বাছাই করে নিয়োগের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রতিটি প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটিতে ইংরেজি অনুবাদের জন্য একজন অনুবাদক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। সুপারিশে আরও বলা হয়, প্রশ্নপত্র বিশেষ লকসংবলিত বাক্সের মাধ্যমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেজারিতে পাঠাতে হবে।

ডাবল লকসংবলিত এ তালা জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে খোলা হবে এবং একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র উপজেলা পরীক্ষা কেন্দ্রে পাঠানো যেতে পারে। পরীক্ষা কেন্দ্রের সংখ্যা যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি উপজেলায় সর্বোচ্চ দুটির বেশি পরীক্ষা কেন্দ্র রাখা সমীচীন হবে না। পরীক্ষা কেন্দ্রগুলো উপজেলা শহরেই থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে যেসব অপরাধীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইনে মামলা করাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা (যেহেতু অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়) অথবা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা করা যেতে পারে। এসব অপরাধে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট থাকলে অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে দুদক আইনে মামলা করতে পারে।