বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি ২০১৭ সালে উদ্বেগজনক ছিল বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। ২০১৭ সালে নারী নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ৮১৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত বছর তা ছিল ৬৫৯ জনে।বিদায়ী বছরে দেশে ৯১ জন নিখোঁজ হয়েছিলেন, তার মধ্যে ৬৫ জনের সন্ধান এখনও মেলেনি।

রোববার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৭: আসক’র পর্যবেক্ষণ’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে একথা জানানো হয়।সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এতো মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি করে একটি দেশ চলতে পারে না। প্রতিবেদন পাঠ করেন আসকে’র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে আসক’র প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পরিচয় দিয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনার পাশাপাশি এ বছরে নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে সাবেক রাষ্ট্রদূত, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, প্রকাশক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা। বিদায়ী বছরে (২০১৭ সালে) গুম হয়েছে ৬০ জন। এদের মধ্যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ২ জনের, গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ৮ জনকে, ফিরে এসেছেন ৭ জন, বাকীদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধসহ গুলিবিনিময়ের নামে ১৬২ জনকে বিচারবর্হিভূতভাবে হত্যা করা হয়।প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এ বছর মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিলের দাবিতে গণমাধ্যম কর্মীরা স্বোচ্চার থাকলেও এর অপপ্রয়োগ অব্যাহত ছিল। ৫৪ জন সাংবাদিক লেখকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ১২২ সাংবাদিক হয়েছেন নির্যাতিত এবং একজন মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে দেশে ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অভিযোগ এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ১২২টি প্রতিমা, পাশাপাশি ৪৫টি বাড়ি, ২১ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙা হয়।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান দিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলেছে, সার্বিক পরিস্থিতি ‘চরম উদ্বেগজনক’। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদন উপস্থাপন করে আসকের সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, ২০১৭ সালের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক।আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনার পাশাপাশি এ বছর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা।গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আসক গুম, খুন, নিখোঁজের এই পরিসংখ্যান দিয়েছে।তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হন ৬০ জন। এর মধ্যে দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়, আটজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়, পরিবারের কাছে ফেরত আসে সাত জন। বাকি ৪৩ জনের খোঁজ মেলেনি এখনও।এছাড়া ‘রহস্যজনক’ নিখোঁজের সংখ্যা আরও ৩১ বলে জানিয়েছে আসক। তাদের মধ্যে ৯ জন ফেরত এলেও তাদের ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী; পরিবারের কাছে ফেরত গেছেন তিনজন।বছরটিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নির্যাতন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা নিয়েও বরাবরের মতো উদ্বেজ জানিয়েছে আসক।তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুলিবিনিময়’ এবং হেফাজতে মোট ১৬২ জন নিহত হন। এর মধ্যে ‘ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গুলিবিনিময়ে’ নিহত হন ১২৬ জন মোবাশ্বার হাসান সিজারের সন্ধান দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশ পরে এই প্রতিবাদ হয়েছিল, সিজারসহ কয়েকজনকে ফেরত পাওয়া গেলেও ফেরেননি বেশিরভাগইমোবাশ্বার হাসান সিজারের সন্ধান দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুখোশ পরে এই প্রতিবাদ হয়েছিল, সিজারসহ কয়েকজনকে ফেরত পাওয়া গেলেও ফেরেননি বেশিরভাগইবাকিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ১২ জন, গ্রেপ্তারের আগে ও পরে ১৮ জন, গ্রেপ্তারের পর আত্মহত্যায় একজন, অসুস্থ হয়ে চারজন এবং একজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়।এছাড়া কারাগারে ৫৩ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৩৩ জন হাজতি ও ২০ জন কয়েদি ছিলেন।বছরটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যও ‘উদ্বেগজনক’ ছিল বলে মন্তব্য করেন ফয়জুল কবির।তিনি বলেন, এ বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের ২১২টি প্রতিমা, ৪৫টি বাড়ি-ঘর ও ২১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। এসব ঘটনায় একজন নিহত ও ৬৭ জন আহত হন।তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার অপব্যবহার এবং মতপ্রকাশের বাধা দেওয়ার ঘটনার কথাও আসে আসকের প্রতিবেদনে।ফয়জুল কবির বলেন, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক, লেখকসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে টিভি টকশোসহ সংবাদমাধ্যমে লেখা ও স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য লেখক, বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মীদের হুমকি ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রভাবশালী, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের দ্বারা ১২২ জন সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতন, হামলা, হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।এ বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটে দ্বারা উত্ত্যক্ত করার ঘটনা বেড়েছে বলে আসকের পর্যবেক্ষণ।ফয়জুল কবির বলেন, যৌন হয়রানিসহ সহিংসতার শিকার হন ২৫৫ জন; এর মধ্যে ১২ জন নারী আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারীসহ ১৩ জন খুন হয়েছেন, বখাটেদের প্রতিবাদ করায় লাঞ্ছিত হয়েছেন ১৬৮ জন ও চার মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ধর্ষণের হাত থেকে এবার শিশু কিংবা বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। এ বছর সারাদেশের ৮১৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা ২০১৬ সালের চেয়ে বেশি। এরবছর ধর্ষণের শিকার হন ৬৫৯ জন।এ বছর সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে ১০ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন জানিয়ে ফয়জুল কবির বলেন, এসব ঘটনার মধ্যে গ্রামছাড়া, সমাজচ্যুত ও একঘরে করে রাখার ঘটনা ঘটেছে তিনিটি, হিল্লা বিয়ে ও দোররার শিকার হয়েছেন আরও তিনজন নারী। এছাড়া শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন চারজন।২০১৭ সালে ৩০৩ জন নারী যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হন জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে ১৪৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ জন আত্মহত্যা করেন। এসব ঘটনায় ১৮৮টি মামলা হয়েছে।এছাড়া এবছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন ৪৪১ জন নারী। এদের মধ্যে স্বামী ও স্বামীর পরিবারের সদস্যদের দ্বারা ২৭০ জন হত্যাকা-ের শিকার হন। নিজ পরিবারে হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ নারী এবং নির্যাতনের ফলে আত্মহত্যা করেন ৫৭ জন নারী। এসব ঘটনায় ২৩৮টি মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসক।অন্যদিকে এবার ৪৩ জন নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হন, এর মধ্যে ২৬ জন গৃহকর্তার বাড়িতে মারা যান। আর অ্যাসিডের শিকার হন ৩২ নারী, এর মধ্যে একজন মারা যান।এ বছর এক হাজার ৬৭৫ শিশু হত্যা ও বিভিন্নভাবে নিযাতনের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন আসক। এর মধ্যে ৩৩৯ শিশু হত্যা করা হয়, আত্মহত্যা করে ১১৭ শিশু ও রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে ৩৭ শিশুর।

এছাড়া এবার শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও উত্ত্যক্তকরণের ৫৬৫টি ঘটনা ঘটেছে।এবার কর্মক্ষেত্রে অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজের কারণে অগ্নিকান্ড ও ভবনধসের ৩০৫টি ঘটনা ঘটেছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এসব দুর্ঘটনায় ৪০৫ জন শ্রমিক নিহত হন।এছাড়া সভা-সমাবেশে বাধা, আদিবাসীদের বাড়িঘরে হামলা, চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈরাজ্য ও ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু, সীমান্তে হত্যা ও নিযাতনের বেশ কিছু ঘটনা তুলে ধরেন আসকের সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।সংবাদ সম্মেলনে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক রওশন জাহান পারভীন ও নীনা গোস্বামী।