রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে আজ থেকে মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ) শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পশ্চিম পাশের মাঠে বাণিজ্য মেলার ব্যবসা করে লাভের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ও বাজার তৈরির পদক্ষেপ নিতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার ২৩তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আপনাদের… শুধু নিজেরা আর্থিক স্বচ্ছলতা আনলে হবে না। সাথে সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। আপনার উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো একান্তভাবে প্রয়োজন।উৎপাদিত পণ্যের জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতেও ব্যবসায়ীদের তাগিদ দেন শেখ হাসিনা।আমাদের আরও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি মনে করি, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িতৃ আমাদের নতুন নতুন পণ্য যেমন উৎপাদন করতে হবে, আমাদের এক্সপোর্ট বাস্কেটটাও বাড়াতে হবে।

আরও কী কী পণ্য বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারে, বিশ্বের কোন দেশে বাংলাদেশের কোন পণ্যের নতুন বাজার আছে, সেখানে কতটা চাহিদাটা আছে- সেসব খুঁজে দেখার ওপর গুরুত্ব দেন সরকারপ্রধান। সেই সঙ্গে পণ্যের মান ও সময়োপযোগিতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্য যাতে বৃদ্ধি পায়; সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে কবে।বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সকালে উদ্বোধনী বক্তব্যের পর ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। পরে তিনি বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।বছরের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাণিজ্য মেলা চলবে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩০ টাকা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।এবার মেলায় বিভিন্ন ক্যাটাগরির ৫৮৯টি প্যাভিলিয়ন ও স্টল রয়েছে। এর মধ্যে ১১২টি বড় ও ৭৭টি ছোট প্যাভিলিয়ন।থাইল্যান্ড, ইরান, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মরিশাস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৪৩টি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিচ্ছে।শিল্পের পাশাপাশি কৃষির ওপর গুরুত্ব আরোপের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। একটা দেশকে উন্নত করতে হলে শিল্পায়নে যেতে হবে। কিন্তু কৃষিকে কোনোভাবে অবহেলা করা যাবে না। কারণ, কৃষিটা অত্যন্ত জরুরি।কৃষির মধ্য দিয়ে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। আবার, এই কৃষির সাথে সাথে আমাদের শিল্পেও যেতে হবে। শিল্প ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্তিত হয় না। আর সেই সাথে সাথে আমাদের রপ্তানিও করতে হবে। সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই আমাদের পরিকল্পিতভাবে নীতিমালা নিতে হবে।প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রতিযোগিতাময় বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের চলতে হবে।উৎপাদিত পণ্যের মানোন্নয়ন ও ব্যান্ডিংয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরনুত্বারোপ করে এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব রকমের সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী। নিজের দায়িত্বের কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব; এটা তো অল্প সময়ের একটা দায়িত্ব। কিন্তু এই সময়টুকু সম্পূর্ণ কাজে লাগাতে চাই… যে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য কতটুকু গড়ে দিতে পারলাম; সেই ভাবেই কাজ করি।এই দেশটি আমাদের, এই দেশটি গড়ে তুলতে হবে আমাদের।ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা আরো বলেন, মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশীয় উদ্যোক্তারা যেমন লাভবান হচ্ছে, নতুন পণ্য প্রদর্শনীর সুযোগ পান, অন্যদিকে দেশি-বিদেশি ক্রেতারা- তাদের রুচি ও চাহিদা পূরণের সুযোগ হয়ে যাচ্ছে এই মেলার মধ্য দিয়ে। ফলে মেলায় পণ্যের মানোন্নয়ন ও বহুমুখী করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

১৯৭১ সালে মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের। এখন তা প্রায় আট লাখ কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন বিশ্বের ৪৬তম বৃহত্তম অর্থনীতি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প প্রায় ৯০ শতাংশ নিজস্ব অর্থায়নে করছি। এখন আমদানি ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ আয় থেকে মেটানো হচ্ছে। আমরা সেই সক্ষমতা অর্জন করেছি। এখন কারও কাছে হাত পেতে চলতে হবে না। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশকে আমরা ছাড়িয়ে গেছি।বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন সংস্থার সূচকের কথাও বক্তব্যে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংকের মতে- অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে একইসঙ্গে উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রীতিমত বিস্ময়।প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স বলেছে, নেক্সট ইলেভেনের প্রথমে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০৫০ সালে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে।অনুষ্ঠানের শুরুতেই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ শীর্ষক একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য।ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন তার বক্তব্যে নতুন মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানকে তার নতুন দায়িত্বের জন্য অভিনন্দন জানান। এছাড়া উপস্থিত বাংলাদেশ বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী আমিনুল ইসলামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি বলেন, “আমরা নামে মাত্র ওয়ানস্টপ সার্ভিস চাই না।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব সুভাশীষ বসু।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যৌথভাবে এই মেলার আয়োজক। থাইল্যান্ড, ইরান, তুরস্ক, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, নেপাল, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, সিঙ্গাপুর, মরিশাস ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১৭টি দেশের ৪৩টি প্রতিষ্ঠান এবারের মেলায় অংশ নিচ্ছে।এবার ৫৮৯টি বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্যাভিলিয়ন ও স্টল নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণ সাজানো হয়েছে। যার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ৩০টি স্টল বরাদ্দ রয়েছে।

বাণিজ্য মেলা (ডিআইটিএফ) বর্তমানে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারেই কাজ করছে না, এটা নগরবাসীর জন্য অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রও হয়ে উঠেছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে মেলার সার্বিক সুশৃঙ্খল আয়োজনে। উদ্যোক্তরা জানান, ‘আমরাও পারি’ থিম নিয়ে আয়োজিত ২৩ তম বাণিজ্য মেলার মূল ফটকটি পদ্মা সেতুতে স্থাপিত প্রথম স্প্যানটির আদলে নির্মাণ করা হয়েছে।মেলার ভেতরটায় বেশ ফাঁকা জায়গা রেখে এর দুই প্রান্ত সুন্দরবন ইকোপার্কের আদলে তৈরি করা হয়েছে। চলার পথগুলো অতীতের চেয়ে আরো প্রশস্থ করা হয়েছে। মেলায় ২টি শিশু পার্ক, রক্ত সংগ্রহ কেন্দ্র, মা ও শিশু কেন্দ্র এবং একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে। রয়েছে অর্কিড বাগান।গত বছরের তুলনায় এ বছর বঙ্গবন্ধু প্যাভিলিয়ননের আকার দ্বিগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় এ প্যাভিলিয়নটি নান্দনিক করে সাজানো হয়েছে। যাতে নতুন প্রজন্ম এবং দেশী-বিদেশী সকলে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারে।

এছাড়া, বাণিজ্য মেলাকে পর্যায়ক্রমে ৩৬০ ডিগ্রি ভার্চুয়াল ট্যুর-এর আওতায় আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। গুগল স্ট্রিট ভিউ, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, গুগলে দেশ-বিদেশ থেকে যে কেউ, যে কোন সময়ে অনলাইনে ঠজ এড়মমষবং-এর সাহায্যে অনলাইনে বসে বাণিজ্যমেলা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে পারবেন। ই-শপের মাধ্যমে বিদেশি ক্রেতারাও পণ্য পরিসেবার আওতায় আসবেন। ডিআইটিএফ-২০১৮ এর লে-আউট প্লান এবার ডিজিটাল ব্লো-আপ বোর্ডের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।মেলার সার্বিক নিরাপত্তায় মেলা প্রাঙ্গণে ১০০টি সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কন্ট্রোল রুম থেকে সিসিটিভি মনিটর করবেন। প্রবেশ গেটে আর্চওয়ে ও মেটাল ডিটেক্টরের ব্যবস্থা রয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবি ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রোভার স্কাউটরা থাকছে।৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এ মেলা উন্মুক্ত থাকবে। প্রবেশ টিকিটের মূল্য প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৩০ টাকা এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।