মধুখালীর মনোরম ম্যানগ্রোভ প্রজাতিন প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ বনা লটির এখন মালিক কে? অন্তত ৬০ বছর আগে মধুখালী লেকের দুইপাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো হাজার হাজার ম্যানগ্রোভ প্রজাতির ছইলা-কেওড়া-বাইনসহ গাছগুলো এখন প্রাচীণ। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর বনবিভাগের কর্মীরা এই গুরুত্বপুর্ণ বনটি দেখাশোনা থেকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। হঠাৎ করে দুইদিন আগে বনবিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা হারুণ-অর-রশীদ লিখিতভাবে ঘোষণা দিলেন এই বাগানের মালিক তারা নন। তাই প্রকৃতির সৌন্দর্যমন্ডিত বন ছাড়াও মধুখালীর দুই দিকের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় সিডরসহ দূর্যোগকালীন প্রাথমিকভাবে সবুজ দেয়ালখ্যাত বনা লটি এখন অরক্ষিত হয়ে গেল। এটির নিয়ন্ত্রণ সরকারিভাবে না থাকলে বনটি বনদস্যুদের কারণে বিরানভূমি হয়ে যাবে। আর সরকার হারাবে কোটি কোটি টাকার বনজ সম্পদ, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধুখালী লেকের দুইপাড়ের বেড়িবাঁধের ভিতরের মানুষ যেমন অনিরাপদ হয়ে যাবে; তেমনি সম্পদও প্রাকৃতিক ঝুঁকির কবলে পড়বে।

সম্প্রতি পূর্ব-মধুখালী এলাকায় দুই শতাধিক গাছ কাটার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে এ বক্তব্য দেয় বনবিভাগ। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাইলে মনোরম এ বনা লটির রক্ষণাবেক্ষণ করবে কারা। এমনিতেই নদীর দুই পাড়ে জেগে ওঠা চরে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বনের দেখভাল বনবিভাগ করে আসছে। এখন বনবিভাগ এর দায় নিচ্ছে না। অথচ এই বনা লের গাছ কাটার কারণে বহু মানুষসহ বনদস্যুদের নামে বনবিভাগ মামলা পর্যন্ত করেছে। নিলামে বহু গাছ বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করেছে। আর এখন বলছে এই বনা ল তাদের নয়। সরকার যেখানে চরসহ বিভিন্ন নদীর পাড়ে বনায়ন করার নতুন নতুন পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধের বাইরে সৃজন করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির ম্যানগ্রোভ প্রজাতির গাছের বাগান। বনবিভাগের এমন উদাসীনতার খবরটি এলাকার সচেতন মানুষকে হতবাক করেছে। প্রবীণ বাসীন্দা আব্দুল জব্বার জানান, বনবিভাগসহ তাঁরা পাহারা দিয়েও গাছ রক্ষা করা যাচ্ছে না। আর এখন তো যে যার মতো করে গাছ কাটতে শুরু করবে। একই মন্তব্য আবুল কালামের। তবে বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদ জানালেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধের রিভার সাইটের অধিগ্রহণ করা জমির ম্যানগ্রোভ গাছপালা তারা রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। আর বাকিটা ভূমি প্রশাসনের।

বনা লটি দেখলে যে কারও মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া লেকটির দুইদিকে মনোরম সৌন্দর্যে ঘেরা দীর্ঘ এ বনা ল। বনটির অধিকাংশ গাছ ম্যানগ্রোভ প্রজাতির। দেশ স্বাধীনের পর থেকে প্রায় দশ কিমি দীর্ঘ লেকের দুই পাড়ের বনা লের হাজার হাজার ছইলা-কেওড়া ও বাইন গাছ রক্ষাণাবেক্ষন করে আসছে বনবিভাগ। অনেক গাছ কেটে ফেলার কারণে বনের পরিধি কমে গেছে এখন। আনুমানিক ছয় কিলোমিটার। এ বনে গাছপালা কাটার অভিযোগে অসংখ্য মামলা পর্যন্ত দায়ের হয়েছে। নিলামে বিক্রি হয়েছে প্রাকৃতিক দূর্যোগে ভেঙ্গে যাওয়া কিংবা মারা যাওয়া অসংখ্য প্রাচীন গাছ। এগাছ গুলো দুই দিকের বেড়িবাঁধের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য সবুজ দেয়াল হিসেবে কাজ করে আসছে। এই বনটি একটি পর্যটন স্পট হওয়ার মতো। সোনাতলা নদীর সংগে রয়েছে মধুখালী শাখা নদীর সংযোগ। জোয়ার-ভাটার প্রবাহে জন্মানো হাজার হাজার ম্যানগ্রোভ প্রজাতির এ গাছের মূল্য কোটি কোটি টাকা। এই বনটি ধংসের আরেকটি কারণ হয়েছে ভূমি বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এরা বনা লকে চাষযোগ্য জমি দেখিয়ে বন্দোবস্ত দিয়েছে। এই সুযোগে বন্দোবস্ত গ্রহীতা গাছ কেটে সাবাড় করে এখন করছে বাড়িঘর। এতোদিন মানুষ এবনটি গাছপালা কাটতনা বনবিভাগের মামলার ভয়ে। এখন বন কর্মকর্তা এটি তাদের নয় আনুষ্ঠানিকভাবে বলে দেয়ায় গোটা বনা লটি উজাড় হওয়ার শঙ্কায় পড়েছে। বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মধুখালীর প্রবীণ বাসীন্দারা জানান, এই বনা লটি না থাকলে তাঁদের জীবন ও সম্পদ ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা থেকে রেহাই পাবে না। তাই এই বনটি রক্ষা করা হোক। সেক্ষেত্রে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির এই বনা লটি আনুষ্ঠানিকভাবে বনবিভাগের কাছে ন্যস্ত করা হোক। নইলে ভূমি প্রশাসনের এখনই বিশেষ নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।স্থানীয়রা জানান, পূর্ব ও পশ্চিম মধুখালী লেকের দু’দিকের মনোরম বিশাল বনা লটির তিন/চার কিমি ইতোমধ্যে উজাড় হয়ে গেছে। এখন গাছ কাটার পাশাপাশি সেখানে বাড়িঘর তোলার হিড়িক চলছে। অন্তত ৩০টি ঘর তোলা হয়েছে বনের মধ্যে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দুই দখলদার হারুন ও আলী হোসেন হাওলাদারকে জিজ্ঞেস করলে এর কোন উত্তর দেন নি। চাষযোগ্য ভূমি দেখিয়ে প্রভাবশালী লোকজনকে ভূমিহীন সাজিয়ে তাদেরকে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। কোটি টাকার বিনিময়ে এসব করা হয়েছে বলে এন্তার অভিযোগ রয়েছে। এখনও বন্দোবস্ত কেসের নথি বের করে যাচাই করলে ধরা পড়বে এরা আসলে কারা।
এব্যাপারে কলাপাড়ার সহকারী কমিশনার (ভূমি) খন্দকার রবিউল ইসলাম জানান, কৃষি জমিছাড়া কাউকে বন্দোবস্ত দেয়ার সুযোগ নেই। কাউকে এমন জমি বন্দোবস্ত দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। আর বনা ল সরকারি খাস জমিতে থাকলে অবশ্যই তা যথাযথ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে নেয়া হবে।