প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগÑরাষ্ট্রের এ তিন অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল একটি দেশ উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারে।যেখানে তিন অঙ্গের মধ্যে কাজের সমন্বয়ের অভাব থাকে, সেখানে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। তিন অঙ্গের কাজের মধ্যে যেন সমন্বয় রক্ষা করা যায়, সে জন্য আমি সব সময় চেষ্টা করব।
শনিবার নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রোববার সকালে প্রথা অনুসারে তাঁকে অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা জানানো হয়। সেখানেই এ কথা বলেন প্রধান বিচারপতি। আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।এ সময় আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, বিচার বিভাগের অগ্রসরতার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, আমি তার সবকিছু করার চেষ্টা করব। বিচার বিভাগের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, বিচারকদের দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, দেশে একটি ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি প্রতিষ্ঠা, মামলা অনুপাতে বিচারকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিচারপ্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালানো ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা আমার প্রাথমিক লক্ষ্য। সকল স্তরের বিচারকেরা যেন তাঁদের এজলাস সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেন, আমি সেটি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করব। তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ৯৫ (২) (গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের আইন প্রণয়ন অপরিহার্য।
প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যেন সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে সংবিধান অনুযায়ী তাঁর নিজ দায়িত্ব পালন করেন, সেটিও আমি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করব। আমাদের এমনভাবে আদালতের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে যেন আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিমান-দুর্বল, ধনী-গরিব, সকলের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে তাঁরা সকলেই সমান। এবং আদালতের কাছ থেকে শুধু আইন অনুযায়ী তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন। এতে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস দৃঢ় হবে।প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, বিচারকদের সবচেয়ে বড় শক্তি সততা। তাঁর জবাবদিহির জায়গা হচ্ছে নিজের বিবেক। সংবিধান ও দেশের আইন তাঁর একমাত্র অনুসরণীয়। শপথকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে বিচারকাজ পরিচালনা করা হবে তাঁর দায়িত্ব। বিচারক যদি শুধু তাঁর শপথ অনুযায়ী বিচারকাজ পরিচালনা করেন, তাহলে তাঁর জন্য আলাদা অনুসরণীয় আচরণবিধির তেমন প্রয়োজন হয় না।বিচারকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি আশা করব, আমার সহকর্মী সকল বিচারক সব সময় তাঁদের শপথের মূল বাণী হৃদয়ে প্রোথিত করে জনগণ ও মানবতার কল্যাণে সংবিধানকে সামনে রেখে বিচারকাজ পরিচালনা করবেন। আবার শুধু বিচার করলেই হবে না, এমনভাবে বিচার করতে হবে যেন সকল পক্ষই নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে সুষ্ঠু ও নিশ্চিতভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের পূর্বসূরি বিচারপতি এস কে সিনহার সময়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের টানাপড়েন ছিল অন্যতম আলোচনার বিষয়।নানা নাটকীয়তার মধ্যে বিচারপতি এস কে সিনহা গত অক্টোবরে ছুটি নিয়ে বিদেশে যান এবং পরের মাসে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন দেশে।
বিচারপতি সিনহা ছুটিতে যাওয়ার সময়ই আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক আবদুল ওয়াহহাব মিঞার হাতে ওই দায়িত্বভার দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। কিন্তু শুক্রবার তিনি নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দিলে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ মাস আগেই পদত্যাগ করেন বিচারপতি ওয়াহহাব মিঞা।শনিবার সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রোববার সকালে তিনি সুপ্রিম কোর্টে এলে রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেনসহ সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তারা তাকে অভ্যর্থনা জানান। রেওয়াজ অনুযায়ী আপিল বিভাগের ১ নম্বর বিচারকক্ষে নতুন প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আপিল ও হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক ও বর্তমান নেতৃবৃন্দ এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- দুই পন্থি আইনজীবীরাই নতুন প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানাতে এ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে শুরুতে বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। পরে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদিন বক্তব্য দেন।এরপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এমন ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে যে, আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ করার সাথে সাথে শক্তিমান দুর্বল, ধনী-গরীব সকলের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে যে, তারা সকলেই সমান এবং আদালতের কাছ থেকে শুধু আইন অনুযায়ী তারা ন্যায্য বিচার পাবেন। এতে করে আদালতের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা দৃঢ় হবে।
নতুন প্রধান বিচারপতির মতে, মামলা জটই এখন আদালতের সবচেয়ে বড় সমস্যা।এই সমস্যা সমাধানে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি অকারণে মামলা মুলতবি, প্রত্যাহারের প্রবণতা পরিহার করতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশনের পথে অগ্রসর হতে হবে।বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের অপরিহার্যতার কথা তুলে ধরে প্রধান বিচারপতি বলেন, সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। বিচারকদের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সততা। তার জবাবদিহিতার জায়গা হচ্ছে তার বিবেক। সংবিধান ও আইন তার একমাত্র অনুসরণীয়।বার ও বেে র মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও সহযোগিতার মনোভাব বজায় রাখার আহ্বান জানান নতুন প্রধান বিচারপতি।সংবর্ধনা শেষে প্রধান বিচারপতি আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ রোববার বেলা সাড়ে ১২টা থেকে বিচার কাজ পরিচালনা করবে।সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানান, বিকালে সাভারে গিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন প্রধান বিচারপতি। তার আগে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাবেন তিনি।