লালমনিরহাট আনন্দ স্কুলের ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর (টিসি) এলিনা পারভীনের অনিয়মের কারনে দিনদিন আনন্দ স্কুলের আনন্দ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে “স্কুল যাই, জীবন বদলাই, আনন্দ স্কুল বদলে দেবে সবার জীবন” এই স্লোগানে এখন আর কোন আনন্দ নেই।

এলিনার অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে অসহায় হতদরিদ্র পরিবারের অর্ধশতাধিক ছাত্র/ছাত্রীর উপবৃত্তির টাকাসহ শিক্ষকের বেতন ফেরত গেল বলে অভিযোগ উঠেছে। আর সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের মহৎ উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংক এবং এসডিসি অর্থসহযোগীতায় দেশের বিভিন্ন উপজেলায় রিচিং আউট অব-স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) ফেইজ-২ প্রকল্প চালু করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বাস্তবায়নে লালমনিরহাটে উক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরেপড়া ছাত্র/ছাত্রীদের আনন্দের মাধ্যমে পাঠদান ব্যবস্থায় ‘আনন্দ স্কুল’। এরলক্ষ্য ২০১৩ সালে লালমনিরহাট সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে ৪৩টি আনন্দ স্কুল স্থাপন করা হয়। তখন ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮০৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০১৭ সালে পিইসিতে ৭৯১জন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। ২০১৫ সালে সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় আরও ৮৩টি আনন্দ স্কুল স্থাপন করা হয়। বর্তমান তাদের ৪র্থ শ্রেনীর পাঠদান চলছে। এরা ২০১৯ সালে পিইসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন। তবে কতটা স্কুল বন্ধ রয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই শিক্ষা অফিস ও ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটরের কাছে।

এসব স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য পোশাক, ৬ মাস পরপর ভাড়া ও বছরে একবার স্কুল ঘর মেরামত, শিক্ষকের বেতন, শিক্ষা উপকরণ, ছাত্র/ছাত্রীর পরীক্ষার ফি টাকা বরাদ্দ প্রতিটি স্কুলের হিসেবে সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখায় জমা হয়। প্রকল্পের নিয়ম অনুয়ায়ী বরাদ্দের উত্তোলনকৃত টাকা সভাপতি এবং স্কুল শিক্ষক মিলে উত্তোলন করে নিজ দায়িত্বে ছাত্র/ছাত্রীর স্কুল ড্রেস, শিক্ষা উপকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করবেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন স্থানীয় লালমনিরহাট সোনালী ব্যাংকের দরজায় দাঁড়িয়ে শিক্ষকরা টাকা উত্তোলনের পরপরই সব টাকা নিয়ে নেন। ছাত্র/ছাত্রীর স্কুল ড্রেস অতি নিম্নমানে, শিক্ষা উপকরণও বিতরনে নানান নয়-ছয়ের আশ্রয় গ্রহন করেন। এমনকি স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় ২শত ৫০ টাকা কর্তন করেন। ফলে বেশিভাগ স্কুল ঘর ভাঙ্গাচুরা রয়েছে। এছাড়াও ৬মাস পরপর দুর-দুরান্তের ছাত্র/ছাত্রীদের উপবৃত্তি বিতরণে ৪/৫টি কেন্দ্রে মিলে ১টি বুথ করে লালমনিরহাট সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা শাহজালাল উপবৃত্তির টাকা বিতরণ করার সময় প্রত্যকের নিকট থেকে ২০টাকা কর্তন করা হয়। এভাবে ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, আনন্দ স্কুল পরির্দশক ও ব্যাংক কর্মকর্তারা মিলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। যা সরেজমিনে তদন্ত করলে প্রমান পাওয়া যাবে।

ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন লালমনিরহাটে যোগদানের পর যেভাবে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন তার ছোট একটি চিত্র তুলে ধরা হল, সদরের খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের হরিণচড়া মধ্যপাড়া আনন্দ স্কুলের ২৬জন ছাত্র/ছাত্রীর জুন থেকে ডিসেম্বর মাসের শিক্ষা উপকরণের বাবদ প্রত্যক শিক্ষার্থীর জন্য ১২০টাকা হিসেবে সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখার চলতি হিসাব নং ৩৩০১৩৬১৮ টাকা জমা হয়। যার স্কুল আইডি নং ৫৫৫২৫৫১২৩। উক্ত স্কুলের কমিটি রেজলুশেন মাধ্যমে এ টাকা উত্তোলন করায় ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন ক্ষিপ্ত হয়ে স্কুল শিক্ষক এরশাদুল হকে নানান ধরণের হুমকি প্রদান করেন।
অবশেষে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের উপকরণের বরাদকৃত টাকা সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখার চলতি হিসাব নং ৩৩০১৩৬১৮ জমা প্রদান করেন। ওইদিনে স্কুল কমিটির নিকট থেকে চেক স্বাক্ষর করে নিয়ে ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন ২৬জন ছাত্র/ছাত্রীর শিক্ষা উপকরণের ১২০টাকা হিসেবে উত্তোলন করেন। সে টাকা দিয়ে প্রত্যক ছাত্র/ছাত্রীদের মাত্র ২০টাকার উপকরণ দিয়ে সমুদয় টাকা আতœসাত করেছেন। তিনি হরিণচড়া ফজলুল হকের বাড়ি আনন্দ স্কুলেও একই ঘটনা ঘটিয়েছেন।
তিনি এখানে ক্ষান্ত হয়নি অবশেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. এম. মিজানুর রহমান ২৬/১০/১৭ইং তারিখে স্বাক্ষরিত একপত্রে হরিণচড়া মধ্যপাড়া আনন্দ স্কুল ও হরিণচড়া ফজলুল হকের বাড়ি আনন্দ স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়। যার স্কুল আইডি নং-১২৩ ও ১৩১। ওই ২টি স্কুলের প্রায় অর্ধশতাধিক ছাত্র/ছাত্রী ৬মাসে উপবৃত্তি ও ২জন শিক্ষাকে ৬মাসের বেতন/ভাতা টাকা ফেরত গেছে।

হরিণচড়া মধ্যপাড়া আনন্দ স্কুলের শিক্ষক এরশাদুল হক জানান, ২০১৫ সালে ৩৫জন শিক্ষার্থী নিয়ে হরিণচড়া মধ্যপাড়া আনন্দ স্কুলও গড়ে তোলা হয়। ২০১৭ সালে শিক্ষার্থীরা ৩য় শ্রেণীতে উর্ত্তীন হলেও হঠাৎ জুলাই/২০১৭ মাস থেকে অলিখিত ভাবে বন্ধ ঘোষনা করা হয়। বছরের মাঝপথে স্কুল বন্ধ করা হয়নি, চালিয়ে যাওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীর লেখাপড়া। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে উপজেলার সকল আনন্দ স্কুলের শিক্ষক বেতন ও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হলেও রহস্যজনক কারণে আইডি নং-১২৩ ও ১৩১ স্কুলের শিক্ষকের বেতন ও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা প্রদান করা হয়নি।

দীঘদিন পর পরর্বতীতে প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. এম. মিজানুর রহমান ২৬/১০/১৭ইং তারিখে স্বাক্ষরিত একপত্রে ১২৩ ও ১৩১ নং আইডিভুক্ত আনন্দ স্কুলের এসিএফ স্থগিতকরা হয়। যার স্মারক নং- প্রাশিঅ/রস্ক ফেইজ-২/খঈ বন্ধ সংক্রান্ত/৩৭০/২০১৫/১৯৩১।

এ বিষয়ে হরিণচড়া মধ্যপাড়া আনন্দ স্কুলের শিক্ষক এরশাদুল হক বলেন, ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীনের অনিয়মের প্রতিবাদ করায় আমার স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি পুরো ৬মাস দায়িত্ব পালন করি। অথচ আমাকে কোন চিঠিপত্র না দিয়ে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে, যখন আমি উপবৃত্তি ও বেতনের টাকা জন্য চাপ দেই, তখন আমার হাতে তুলে দেওয়া হয় স্কুল বন্ধের অনুলিপি ফটোকপি। ফলে আমরা স্কুল ২টি’র অর্ধশতাধিক ছাত্র/ছাত্রী উপবৃত্তি ও শিক্ষকরা বেতন/ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি।

হরিণচড়া ফজলুল হকের বাড়ি আনন্দ স্কুলের শিক্ষক নুরনবী বলেন, ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন যোগদানের পর থেকে অনিয়ম শুরু হয়েছে। আমি পুরো ৬মাস বেতন পাবো। আমার স্কুলের ছাত্র/ছাত্রীরা ৬মাসের উপবৃত্তি টাকা পায়নি।

আনন্দ স্কুলের ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটর এলিনা পারভীন তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ২টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষক ৬মাসেরবেতন/উপবৃত্তির টাকা পায়নি। কত টাকা ফেরত গেছে সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখা ব্যবস্থাপক ভাল জানেন। আমার কাছে ওইসব তথ্য নেই।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক, লালমনিরহাট শাখা ব্যবস্থাপক ওয়াহেদুর নবী’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আনন্দ স্কুল বন্ধের চিঠিপত্র পেয়েছি কিনা তা জানা নেই। যদি কোন আনন্দ স্কুল স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়, তাহলে সে অর্থ ফেরত যাবে। ২০১৭ সালে কত টাকা ফেরত গেছে এমন প্রশ্নে উত্তরে ব্যবস্থাপক বলেন, এ তথ্য শিক্ষা অফিসে রয়েছে। সেখান থেকে সংগ্রহ করুন, ব্যাংক থেকে তথ্য দেওয়া যাবে না।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুস সালাম বলেন, কিছু কিছু আনন্দ স্কুলে অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। এখন ভাল চলছে। আর যদি কোন অনিয়ম হয় তাহলে স্থানীয় কমিটি এর সাথে জড়িত। ২টি স্কুলের শিক্ষার্থীরা ও শিক্ষক ৬মাসের বেতন/উপবৃত্তির টাকা ফেরতের বিষয় তিনি কিছুই বলতে পারেনি, এবিষয়টি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভাল জানান।