এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ জনের মধ্যে সাতজনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম আবু সাঈদ এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।শনিবার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এঁদের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী ও শেরেবাংলা নগর থানায় দুটি মামলা করা হয়। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে হাজারীবাগ ও নিউমার্কেট থানায় পৃথক দুটি মামলা করে শিক্ষা বোর্ড। যে সাতজনকে দুদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন পটুয়াখালীর রাহাত ইসলাম (২৩), দোহারের সালাউদ্দীন (২৩), টাঙ্গাইলের মো. সুজন (২০), জামালপুরের জাহিদ হোসেন (২০), ফরিদপুরের সুফল রায় (১৮), কুমিল্লার আলামিন (২০) ও সাইদুল ইসলাম (১৯)। তাঁদের গতকাল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের কাছ থেকে কয়েকটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। আজ ডিবির উপপরিদর্শক হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে পাবলিক পরীক্ষা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করেন।

আজ যাত্রাবাড়ী থানায় করা এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির উপপরিদর্শক হাবিবুর রহমান তাঁদের আদালতে হাজির করে সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। সেখানে বলা হয়, চলতি বছরে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস চক্রে কয়েকজন সদস্য যাত্রাবাড়ী কাজলা এলাকায় অবস্থান করছিলেনÑএমন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে গিয়ে রাহাত ইসলাম ও সালাউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইল ফোন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাহাত ও সালাউদ্দীন এসএসসি পরীক্ষার ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন পরীক্ষার্থীর কাছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে আসছিলেন। এর সূত্র ধরে তাঁদের সহযোগীদের ঢাকা উত্তরার কাফরুল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব আসামি টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র বিক্রি করার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন। এ ঘটনার অন্যান্য পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তার করার জন্য তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি।আদালতে শুনানির সময় আসামি সালাউদ্দিনের পক্ষে আইনজীবী আখতারুল ইসলাম আদালতকে বলেন, তাঁর মক্কেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত না। এই আইনজীবীর মতো অন্য আইনজীবীরাও আদালতকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে এই আসামিরা জড়িত নন। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে দুই দুনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গ্রেপ্তারের পর পুলিশ আসামি রাহাতের মোবাইলের ২২টি স্ক্রিনশট, সুজনের মোবাইলের ৭টি স্ক্রিনশট, জাহিদের ১৮টি স্ক্রিনশট এবং সুফলের মোবাইলে ২২টি স্ক্রিনশট জব্দ করে।আমান উল্লাহ, বরকত উল্লাহ, আহসান উল্লাহÑতাঁরা আপন তিন ভাই। চাঁদপুর থেকে এসে তাঁরা বসবাস শুরু করেন রাজধানী ঢাকার ইন্দিরা রোডের একটি বাসায়। এসএসসি পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে এই তিন ভাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণা দেন। তাঁরা এমনও বলেন, তাঁদের কেউ ধরতে পারবে না, ধরার সামর্থ্যও নেই। ওই তিন ভাইসহ প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া বাকি ১১ জন হলেন রাহাত ইসলাম, সালাউদ্দিন, সুজন, জাহিদ হোসেন, সুফল রায় ওরফে শাওন, আল আমিন, সাইদুল ইসলাম, আবির ইসলাম, শাহাদত হোসেন, ফাহিম ইসলাম ও তাহসিব রহমান।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শনিবার তাঁদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তর বিভাগ। গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজে ব্যবহৃত ডিভাইস, যেমন: এইচপি ল্যাপটপ, স্যামসাং, নকিয়া, সিম্ফোনি, লাভা, হুয়েই, লেনোভো, আইফোন ব্রান্ডের মোট ২৩টি মুঠোফোন ও নগদ ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।রোববার দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান ডিবির যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই উল্লাহ বাহিনীর মধ্যে আমান উল্লাহ সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তাঁরা মূলত মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমোতে গ্রুপ ওপেন করে অ্যাডমিন পরিচালনা করতেন। অনেক ছাত্রকে তাঁরা গ্রুপের সদস্য করতেন। যেদিন যে পরীক্ষা হবে, সেই পরীক্ষার ভিত্তিতে গ্রুপ খোলা হতো।প্রশ্নপত্র ফাঁসে ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইস ও নগদ অর্থ। মিন্টো রোড, ঢাকা, রোববার, ২০১৮, প্রথম আলো।পরীক্ষা শুরু হওয়ার সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগেই আসল প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় মন্তব্য করে আবদুল বাতেন বলেন, পরীক্ষার এক দিন আগে ভুয়া প্রশ্নপত্র ছড়াতেন তাঁরা। প্রকৃত প্রশ্নের সঙ্গে এসব প্রশ্নের মিল নেই। তবে পরীক্ষার দিন কেন্দ্র থেকে পরীক্ষার হলে আনার সময় প্রশ্নপত্রের বান্ডেল খোলা হয়। বান্ডেল খোলার আগে এই প্রশ্ন দেখার সুযোগ কারও নেই। কেন্দ্র থেকে কক্ষে যাওয়ার সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটে। পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগে কোনো ‘দুষ্টু’ লোক মোবাইলে ছবি তুলে গ্রুপগুলোয় ছেড়ে দেয়। এমসিকিউ পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই কাজ বেশি হয়। এই প্রশ্ন সরাসরি ছাত্রদের মধ্যে পৌঁছানো বেশ কঠিন। বেশির ভাগ সময় পরীক্ষার সকালে, কখনো কখনো পরীক্ষার আগের দিন রাতে একেক গ্রুপ একেক ধরনের প্রশ্নের সেট বিক্রি ও সরবরাহ করতে থাকে, যা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তাঁরা এসব প্রশ্ন বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে পাঁচ শ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেন।প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা বোর্ডের কারও সম্পৃক্ততা এ পর্যন্ত তদন্তে তাঁরা পাননি বলে জানান আবদুল বাতেন।১ ফেব্র“য়ারি থেকে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এবার পরীক্ষায় ২০ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা শুরুর পর বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ধর্ম বিষয়ের পর গতকাল গণিতেরও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়।প্রথম দুদিনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ৪ ফেব্র“য়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সেই কমিটি এখনো কাজই শুরু করেনি। ফাঁস হওয়া বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল হবে কি না, তা এই কমিটির দেখার কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এই কমিটির কার্যপরিধি ঠিক করে দেওয়ার কথা।কমিটির প্রধান কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বলেন, তিনি এখনো কমিটির আদেশই পাননি