ভালোবাসার হরেক রং। সেরাটা দেশপ্রেম। তারপরেই আতœপ্রেম। মায়ের ভাষাকে যারা ভালোবেসে রক্ষা করতে সংগ্রাম করেছিলেন। তাদেরই একজন ভাষাসংগ্রামীর গল্প । আমি তখন চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ উচ্চ বিদ্যায়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র। ভাষার লড়াইটা তখনই শুরু হয়েছিল। আমরা সে লড়াইয়ে সামিল হয়েছিলাম এই মফস্বল শহর থেকে। ফেব্রুয়ারী মাস এলেই প্রয়াত সহপাঠীদের ভীষণ মনে পড়ে এখনও। তাদের সাথেই ভাষার দাবীতে পথে বিক্ষোভ মিছিল-সভা, ক্লাস বর্জন করেছিলাম। আজ তারা প্রায় কেউ বেঁচে নেই। আমি বেঁচে আছি এখনো তাদের সেই স্মৃতি বুকে নিয়ে । পাবনার চাটমোহরে ১১ জনের মধ্যে জীবিত একমাত্র ভাষাসংগ্রামী অ্যাডভোকেট গৌরচন্দ্র সরকার ৬৫ বছর আগের স্মৃতি হাতরে আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। পৌরসভার দোলং মহল্লার স্থায়ী বাসিন্দা তিনি। ৮৯ বছরে এসেও গৌরচন্দ্র সরকার এখনো একজন কর্মঠ মানুষ। প্রায় ১৪ বছর হলো প্রতিদিন বাসে চড়ে পাবনা আদালতে আইন ব্যবসা করছেন একই পেশার ছোট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে।

তিনি বলেন, ’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ভাষাশহীদদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হলো। ২২ ফেব্রুয়ারী তার প্রতিবাদে আমরা চাটমোহরে ক্লাস বর্জন করি। এদিনই পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ছাত্রনেতা কামাল লোহানী, ভাষা মতিন, রণেশ মৈত্র, আব্দুল আজীজ, আশরাফ আলী আসেন চাটমোহরে। আমাদের রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শভুনাথ উচ্চবিদ্যালয়ের কদমতলায় আমার সভাপতিত্বে এক সভা হয়। সেদিন আমরা মিছিলও করি। সেদিন সভায় উপস্থিত ছিলেন আবুল হোসেন, আবদুল হামিদ সরকার, ওমর আলী, ইছহাক আলী দীপু, ক্ষীরদ সরকার, আ. রহিম সরকার, খতিব মমতাজ, খতিব হাবিবুর রহমান, আ. লতিফ সরকার, ও আ. সালাম। সে সভায় ১১ সদস্যের ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আমরা তখন সবাই নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। সভা শেষে একটি মিছিল নিয়ে আমরা স্কুলের বালুচর খেলার মাঠে এলে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তাতে যোগ দেন। ময়েনউদ্দিন মোল্লার সভাপতিত্বে সেখানে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তারা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার শপথ নেন। এ সময় ক্লাস বর্জনের ঘোষণাও দেওয়া হয়। এই সভার পর ছাত্ররা পাবনার নেতাদের সঙ্গে মিছিল করে থানা মোড়ে গিয়ে একটি পথসভা করেন। এরপর পাবনার নেতারা ট্রেনযোগে ভাঙ্গুড়ায় চলে যান। ২৩ ফেব্রুয়ারী রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শভুনাথ হাইস্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে স্কুলের ইন্দারার পাশে সমবেত হয়। সেখান থেকে মিছিল বেরোনোর সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক এর সহায়তায় থানার তৎকালীন দারোগা নিশান আলী পুলিশ নিয়ে মিছিলে বাধা দেয়। ভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের থানায় ধরে নিয়ে যায়। এরপর গ্রেফতারকৃতদের বিকেলে ছেড়ে দেওয়া হয়।

২৪ ফেব্রুয়ারী হাইস্কুলের কদমতলায় শিক্ষক নারায়ণ চন্দ্র চৌধুরীর সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে একটি মিছিল নিয়ে ছাত্ররা থানা মোড়ে আসে। সেখানে সংগ্রাম কমিটির সম্পাদক আবুল হোসেন ২৮ ফেব্রুয়ারী ব্যাপক কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারী রাতে মথুরাপুর গ্রামের বাড়ি থেকে আবুল হোসেনকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। পরদিন ২৮ ফেব্রুয়ারী তাকে পাবনা কারাগারে পাঠানো হয়। পাবনায় এক মাস এবং রাজশাহী কারাগারে আট দিন আটক রাখার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। সে সময় তার সাথে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের পূর্বে উল্লেখিত ছাত্রনেতারাও রাজশাহী কারাগারে ছিলেন। জেল থেকে ফিরে এসে স্কুলে মুচলেকা দিয়ে আবার ভর্তি হতে বলা হয় তাকে। ঘৃণা আর অভিমানে আবুল হোসেন আর স্কুলে ভর্তি হননি। ৬৮ বছর আগের স্মৃতির বাক্স হাতরে ভাষাসৈনিক গৌরচন্দ্র বলেন, আমাদের সবাইকে গ্রেফতার করে পরে ছেড়ে দেয় পুলিশ। তিনি বলেন, সে সময় পাবনায় শুধু এডওয়ার্ড কলেজ আর চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ বাবু শম্ভুনাথ হাইস্কুলে ভাষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। গৌরচন্দ সরকার ৩৯ বছর শিক্ষতা করেছেন। ’৫২ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। ২০ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন থানা আওয়ামী লীগের। বর্তমানে তিন ছেলে, ছয় মেয়ে তার। সবাই উচ্চশিক্ষিত। ছোট মেয়েটি এমএ ও এলএলবি পাস করে বাবার সঙ্গে আইন ব্যবসা করছেন। বড় ছেলে আয়কর কর্মকর্তা বিদ্যুৎ চন্দ্র সরকার বলেন, বাবা কখনো জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে চাননি। সাদাসিধে জীবন যাপন করছেন। প্রচলিত রাজনীতির নেতৃত্বে থাকলেও ৫২-এর সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি কখনো।

এস এম মাসুদ রানা, চাটমোহর, পাবনা