আওয়ামী লীগ দেশকে খাদ্য ঘাটতি থেকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে রূপান্তর করেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সতের কোটি মানুষের বাংলাদেশে কৃষি জমি যে বাড়ছে না, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষি গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ১৪২৩ প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ বিতরণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা।বলেন, দেশের লোকসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। সেই সঙ্গে খাদ্যের উৎপাদনও বাড়াতে হবে। কিন্তু জমির পরিমাণ ঠিক সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।এ কারণে তিনি কৃষি গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি পরিকল্পিত শিল্পায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করের।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা নির্দেশ দিয়েছি দুই ফসলি বা তিন ফসলি জমি কোনোভাবেই এ কাজে ব্যবহার করা যাবে না। অন্য জমিগুলোতে আমরা শিল্পায়ন থেকে শুরু করে যা যা করার করব। এটা আমাদের পরিবল্পিতভাবে করতে হবে।খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ২০০৫-০৬ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের উৎপাদনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন অনুষ্ঠানে।তিনি বলেন, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশে যেখানে ২ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা প্রায় তিন কোটি ৮৭ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের বর্তমানে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে।কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের উৎসাহিত করতে ১৯৭৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু পুরস্কার তহবিল’ গঠন করা হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর এ পুরস্কার বিতরণসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।২০০৯ সালের পুনরায় এ পুরস্কার চালু করা হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার ট্রাস্ট আইন, ২০১৬’ করে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। বর্তমানে ওই ট্রাস্টের অধীনেই এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

এর আওতায় প্রতিবছর পাঁচ জনকে স্বর্ণ, নয় জনকে রৌপ্য এবং ১৮ জনকে ব্রোঞ্জ দেওয়া হয়। ২৫ গ্রাম ওজনের পদকের সঙ্গে স্বর্ণপদকপ্রাপ্তরা এক লাখ টাকা, রৌপ্যপদকপ্রাপ্তরা ৫০ হাজার টাকা এবং ব্রোঞ্জপদকপ্রাপ্তরা ২৫ হাজার টাকা পান।বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনের জন্য পাবনা থেকে সংসদ সদস্য মো. মকবুল হোসেন ও ভোলার নাজিমউদ্দিন চৌধুরী এবার কৃষি সম্প্রসারণে স্বর্ণপদক পেয়েছেন। কৃষি গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ড. রাখহরি সরকার এবং কৃষি সম্প্রসারণে কিশোরগঞ্জে মো. আমিনুল ইসলাম এ পদক পেয়েছেন। মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিতে অবদানের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়েছে এবার।উন্নত কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে অবদানের জন্য কৃষি গবেষণায় রৌপ্য পদক পেয়েছে গোল্ডেন বার্ন কিংডম প্রাইভেট লিমিটেড।

কৃষিতে নারীদের অবদানের জন্য খুলনার বেগম সালেহা ইকবাল, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য ময়মনসিংহের মো. সেলিম রেজা, কৃষি সম্প্রসারণে কুমিল্লার মোসাম্মত সুলতানা ইয়াসমিন ও ঝিনাইদহের ড. খান মো. মনিরুজ্জামান, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষে ঝিনাইদহের বেগম লাভলী ইয়াসমিন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু পালন ও খামার প্রতিষ্ঠায় চট্টগ্রামের মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন হায়দার, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি চাষে সাফল্যের জন্য নওগাঁর সংসদ সদস্য মো. ইসরাফিল আলম, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনে ঢাকার সাখাওয়াত হোসেন রৌপ্য পদক পেয়েছেন। কৃষি সম্প্রসারণে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের কৃষি অফিসার মোহাম্মদ আবদুল কাদির ও কুষ্টিয়ার মো. বকুল হোসেন; উচ্চমানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণে মানিকগঞ্জের মো. আমজাদ হোসেন, কৃষি উন্নয়নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারে টাঙ্গাইলের মো. শহিদুল ইসলাম খান ও জামালপুরের শেখ মো. মুজাহিদ নোমানী; পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে কিশোরগঞ্জের মো. নিজাম উদ্দিন; কৃষিতে নারীর অবদানের জন্য শিখা রানী চক্রবর্তী ও যশোরের বেগম ফারহানা ইয়াসমিন; বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনের জন্য পিরোজপুরের শেখ হুমায়ুন কবির, মাগুরার মো. বাবুল আক্তার, ঠাকুরগাঁওয়ের মো. মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী ও ঝালকাঠির মো. মাহফুজুর রহমান; বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খামার স্থাপনের জন্য বান্দরবানের সিংপাত ¤্রাে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মৎস্য চাষের জন্য কুমিল্লার ছারোয়ার আলম মজুমদার বাবুল ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন।

এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণে নীলফামারীর মেসার্স ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে রংপুরের ময়েনপুর কৃষি তথ্যও যোগাযোগ কেন্দ্র এবং বাণিজ্যিক বনায়নের জন্য কুষ্টিয়ার চিথলিয়া সিআইজি (ফসল) সমবায় সমিতি লিমিটেড ও রাজশাহীর বরেন্দ্র গালিজ কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছে।এ নিয়ে ৩১ বারে মোট ১০৭৩ জনকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার দেওয়া হল। গত নয় বছরে বিএডিসির মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের সাড়ে দশ লাখ মেট্রিক টন মানসম্পন্ন বীজ বিতরণের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে বলেন, “বিএডিসিকে বিএনপি সরকারের আমলে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। এটা নাকি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শ ছিল; এটা নাকি কোনো লাভজনক প্রতিষ্ঠান না। আর বীজ উৎপাদন বেসরকারি হাতে দিয়ে দিয়েছিল। ফলে বীজের মান ঠিক ছিল না।আমরা সরকারে এসে সরকারি খাতে বীজ উৎপাদন শুরু করি। কারণ আমার গরীব কৃষকরা যেন ন্যায্য মূল্যে উন্নত বীজ পেতে পারে। এটার মান ধরে রাখতে হলে আমাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান একান্তভাবে দরকার।দেশের সব খাল ও পুকুর খননের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রকল্প নেওয়ার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।প্রতিটি এলাকার খাল, বিল ও পুকুর আমরা সংস্কার করব। সেখানে যেন পানি ধারণ ক্ষমতাটা বৃদ্ধি পায়ৃ তার ফলে সেখানে মাছের উৎপাদনও বাড়বে।

সেচের জন্য ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করে ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোরও উদ্যোগও প্রক্রিয়াধীন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।তিনি জানান, গত নয় বছরে সব খাত মিলিয়ে মোট ৬০ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাবদ ৭৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন এলাকায় কোন পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়, সেভাবেই হিসাব করে, সেগুলো সংক্ষণ করা এবং তা প্রক্রিয়াজাত করাৃ আমরা যদি এটা করতে পারি তাহলে দেশের চাহিদাও মেটাতে পারব, আর বিদেশেও রপ্তানি করতে পারব।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছি। সেখানে যে বিনিয়োগ হবেৃ বিনিয়োগকারীদের আমি আহ্বান করব; সেখানে কৃষিপণ্যগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করার শিল্পও যেন তারা গড়ে তোলেন।

নতুন প্রজস্মকে কৃষি কাজে আগ্রহী করতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তরুণরা এখন লেখাপড়া শেখার পর আর জমিতে কাজ করতে যেতে চায় না।কৃষি কাজে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন আন্তরিক হয় এবং তাদের একটা ব্যবহারিক শিক্ষা যেন থাকে; সে দিকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষি থেকে ধীরে ধীরে শিল্পেও উন্নতি হবে। কিন্তু কৃষিকে বাদ দিয়ে তা হবে না, কারণ কৃষিই কাঁচামালের জোগান দেবে।আর আমার খাদ্যের জোগান দেবে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষার্থীদের এই শিক্ষাটা দেওয়া উচিত। মাটিতে হাত দিয়ে কাজ করলে বা চারা রোপণ করলে এতে লজ্জার কিছু নেই। বরং নিজের হাতে বাগান করলে, সেই বাগানের একটি ফল ছিড়ে খেতে গর্ব হয়।কৃষির মাধ্যমে স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা চাইম আমাদের নিজেদের উৎপাদন আমরা নিজেরা করব। আমরা কারো কাছে হাত পেতে চলব না। আমরা নিজেরা মর্যাদার সাথে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলব। দারিদ্র্যমুক্ত ও ক্ষুধাধামুক্ত দেশ গড়ে তুলতে কৃষিই হবে আমাদের মূল শক্তি।কৃষিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। স্বাগত বক্তব্য দেন কৃষি সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।