বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন উইলিয়াম হকিং আর নেই। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বর ও আপেক্ষিকতাবাদের জন্য তিনি জগৎজোড়া কিংবদন্তি বিজ্ঞানীর মর্যাদায় আসীন ছিলেন। ৭৬ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞানী মারা যান বলে পরিবারের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বুধবার সকালে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির লুকাসিয়ান অধ্যাপক ছিলেন, যে পদে একসময় ছিলেন স্যার আইজাক নিউটন।

স্টিফেন উইলিয়াম হকিংয়ের তিন সন্তান লুসি, রবার্ট ও টিম বলেছেন, ‘আমরা গভীর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানাচ্ছি, আমাদের পরম ভালোবাসার বাবা আর নেই।’ ‘তিনি একজন জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তাঁর কাজ ও উত্তরাধিকার অনেক বছর ধরে বেঁচে থাকবে,’ যোগ করেন হকিংয়ের সন্তানরা।

হকিং ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং ছিলেন জীববিজ্ঞানের গবেষক আর মা ইসাবেলা ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। উত্তর লন্ডনের এই পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্সফোর্ডে আসে। ছেলেবেলা থেকেই হকিংয়ের আগ্রহ ছিল বিজ্ঞান আর গণিতে।

মাত্র ২১ বছর বয়সে হকিং মোটর নিউরন নামে এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। পরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে হুইলচেয়ারেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটান। মুখের পেশির নড়াচড়ার মাধ্যমে কম্পিউটারে তৈরি করা স্বরে তিনি অর্থপূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। সমস্ত শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে তিনি সৃষ্টিতত্ত্ব ও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে বিকাশিত করেন।

মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে নানা কথা চালু থাকলেও হকিং মনে করতেন, এ শুধুই রূপকথা। সেই রূপকথার জগতেই ঠাঁই নিলেন এই বিজ্ঞানী।

সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ গ্রন্থটি হকিংকে সাধারণ বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তোলে। এ বইটি সারা বিশ্বে কয়েক কোটি বিক্রি হয়। তিনি প্রিন্স অব অস্ট্রিয়ান্স পুরস্কার, জুলিয়াস এডগার লিলিয়েনফেল্ড পুরস্কার, উলফ পুরস্কার, কোপলি পদক, এডিংটন পদক, হিউ পদক, আলবার্ট আইনস্টাইন পদক অর্জন করেছিলেন।

হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক চাইতেন, ছেলেও তাঁর মতো চিকিৎসক হোক। কিন্তু হকিংসের আগ্রহ ছিল গণিতে। তাই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু সেখানে গণিত কোর্স না থাকায় পরে পদার্থবিজ্ঞানে পড়া শুরু করেন। পদার্থবিজ্ঞানে হকিংসের আগ্রহের বিষয়গুলো ছিল অপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা, কোয়ান্টামবিদ্যা।

১৯৭৪ সালে বিকিরণতত্ত্ব দেন হকিংস, যা ‘হকিংস রেডিয়েশন’ নামে পরিচিত। ১৯৬৩ সালে স্টিফেন হকিংস মোটর নিউরনে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর চিকিৎসক বলেছিলেন, আর মাত্র দুই বছর বাঁচবেন তিনি। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতাকে জয় করে ৭৬ পূর্ণ করেছিলেন এই বিজ্ঞানী।

তবে বেঁচে থাকলেও এই রোগ তাঁর স্বাভাবিক চলাফেরার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই তিনি কথা বলতে ও নড়াচড়া করতে পারতেন না। তবুও থেমে থাকেনি তাঁর কাজ। তিনি কথা বলতে শুরু করেন ভয়েস সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে। এই যন্ত্র হকিংসের মুখের পেশির নড়াচড়া অনুযায়ী কথা বলত। এ ছাড়া গলার কম্পাঙ্ক এবং চোখের পাতার নড়াচড়া অনুযায়ী লিখতে পারতেন। আর এইভাবেই বাকি জীবন কাজ করে গেছেন হকিং।

২০১৩ সালে করা এক প্রামাণ্যচিত্রে স্টিফেন হকিংস বলেছিলেন, ‘প্রতিদিনই আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারত। তাই আমি প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে চাই।’