জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাদন্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিনের বিরুদ্ধে আপিলের (লিভ টু আপিল) শুনানি শেষ হয়েছে।সোমবার এ বিষয়ে আদেশের জন্য দিন ঠিক করেছে আদালত।রোববার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে এ আদেশ দিয়েছে আদালত।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।অপরদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও খন্দকার মাহবুব হোসেন।সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে আপিল বিভাগে খালেদা জিয়ার জামিনের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানি শুরু হয়ে মাঝে আধা ঘণ্টার বিরতি দিয়ে শুনানি শেষ হয় বেলা ১২টায়।হাই কোর্টের জামিন আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে রোববার আপিল বিভাগ বিষয়টি সোমবার আদেশের জন্য রাখে।সকালে লিভ টু আপিলের শুনানির শুরুতে দুদকের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এরপর রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তি দেখান।

খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন তার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাদের যুক্তি উপস্থাপন শেষে আদালত জানায়, আদেশ হবে সোমবার।

এদিন সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। বিচারপ্রার্থীসহ সবাইকে আদালত চত্বরে প্রবেশ করতে হয় কড়া তল্লাশির মধ্যে দিয়ে।জিয়া এতিমখানা মামলায় গত ৮ ফেব্র“য়ারি ঢাকার জজ আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদন্ড দেওয়ার পর থেকে তিনি পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন সড়কের পুরনো কারাগারে বন্দি।পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার পর মামলার নথি নিম্ন আদালত থেকে এনে তা দেখে গত ১২ মার্চ খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেয় হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে সর্বোচ্চ আদালত গত ১৪ মার্চ জামিন রোববার পর্যন্ত স্থগিত করে এই সময়ের মধ্যে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আলিভ টু আপিল করতে বলে। এর ধারাবাহিকতায় রোববার বিষয়টি আপিল বিভাগে আসে।

শুনানির পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, হাই কোর্ট যে যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে জামিন দিয়েছে সেটা সঠিক হয়নি। সাজা ভোগ করা সময় শেষ হয়ে গেছে, অথচ আপিল শুনানি হয়নি- এ রকম কোনো ঘটনা এখানে ঘটেনি। খালেদা জিয়ার দন্ড পাঁচ বছর। এর মধ্যে আপিলটা দ্রুত শুনানি করা সম্ভব- এটা আমরা শুনানিতে বলেছি।খালেদা জিয়ার বয়স ও সামাজিক মর্যাদার বিষয়ও আপিল বিভাগে আলোচনায় এসেছে বলে অ্যাটর্নি জেনারেল জানান।তিনি বলেন, তাকে (খালেদা জিয়া) ১০ বছরই সাজা দেওয়ার কথা। কিন্তু বয়স ও সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করেই নিম্ন আদালত তাকে পাঁচ বছর সাজা দিয়েছে। যে বিবেচনা করে নিম্ন আদালত সাজা কমিয়ে দিয়েছে, সেই একই বিবেচনা করে হাই কোর্ট তাকে জামিন দিয়েছে।

মাহবুবে আলমের যুক্তি, বয়স ও সামাজিক মর্যাদা ৪৯৭ ধারা বলে বিচারাধীন মামলার কারাবন্দি আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। যেখানে সাজা হয়ে গেছে,সেখানে প্রযোজ্য হবে ৪২৬ ধারা। সেখানে বয়স বা অসুস্থতার কথা বলা নেই।সবচেয়ে বড় কথা হল, রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হন, আদালত কঠোরভাবে তার বিচার করে। বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, রাষ্ট্রনায়করা দেশ থেকেই পালিয়ে গেছেন ভয়ে বা দ- এড়ানোর জন্য। এখানে যে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে, এই পাঁচ বছরের মধ্যে মাত্র দুই মাস-আড়াই মাস গেছে। অন্য একজন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, তারও পাঁচ বছর সাজা হয়েছিল। তাকে সাড়ে তিন বছর সাজা ভোগ করতে হয়েছে।অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিলে দীর্ঘ সময় শুনানির প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে তার জামিন বিবেচেনা করা যেতে পারে। আমরা বারবার বলছি আপিলটার শুনানি হোক। চার মাস সময় বেঁধে দিয়েছে হাই কোর্ট। আমি বলেছি, প্রয়োজনে আরও সংক্ষিপ্ত সময় দেওয়া হোক আপিলের পেপারবুক তৈরি করার জন্য। তারপরও আপিল শুনানি করে উনি যদি মুক্ত হতে পারেন ভাল কথা।

আরও কম সময়ে আপিল শুনানি কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, সম্ভব। এই মামলার সাক্ষী মাত্র ৩২ জন। আর কিছু কাগজপত্রৃ যে মামলাটিতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল যেন বিচারই শেষ না হয়, সেখানে আপিলটা পেন্ডিং থাকলে আর উনি যদি জামিন পেয়ে গেলে বিচারই হয়ত অকার্যকর হয়ে যাবে।খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মূলত রাজনৈতিকভাবে এ মামলাটির মেরিটে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং অনেকগুলো বিষয়ের কথা তিনি বলেছেন। পরে আমরা অনেকগুলো সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে বলেছি, উপমহাদেশে এবং আমাদের দেশে যতগুলো সিদ্ধান্ত আছে, সে মোতাবেক হাই কোর্ট বিভাগ যদি কোনো জামিন আবেদন গ্রহণ করেন এবং জামিন দেন এবং সেখানে যদি কারণ উল্লেখ করে জামিন দিয়ে থাকেন. সেক্ষেত্রে সাধারণত আপিল বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করে না।জয়নুল বলেন, আমরা মনে করি, আইনগত যে দিকগুলো আমরা আদালতে তুলে ধরেছি, ইনশাল্লাহ সবই আমাদের পক্ষে। দুদক-রাষ্ট্রপক্ষ এর কোনো পাল্টা যুক্তি দিতে পারেনি। ফলে আমরা আশা করি, হাই কোর্ট যে জামিন আদেশটি দিয়েছে, সেটি বহাল রাখবে আপিল বিভাগ।দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, যে চারটি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে হাই কোর্ট জামিন দিয়েছে, সেগুলো তিনি সর্বোচ্চ আদালতের শুনানিতে খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন।এর পক্ষে একটা রায় উপস্থাপন করে বলেছি, দুই বছরের সাজায় উনি জামিন দেননি। আবেদনকারীকে বলেছিলেন, হাই কোর্টে গিয়ে নতুন করে শুনানি করতে। শুনানির সুযোগ না হলে আবার নতুন করে জামিন আবেদন করতে।খুরশীদ আলম খান বলেন, মেডিকেলের একটা গ্রাউন্ডে হাই কোর্ট জামিন দিয়েছে। আমরা বলেছি হাই কোর্টে মেডিকেল সার্টিফিকেটের পক্ষে কোনো কাগজ তারা দিতে পারেননি। খালেদা জিয়া এ মামলায় জামিনে থাকাকালে জামিনের অপব্যবহার করেননি উল্লেখ করে হাই কোর্ট জামিন দিয়েছেন। তাও সঠিক নয়। উনি আদালতের অনুমতি না নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন।