১৯৭০-৭১ সালে আমি বেশ ছোট, তবে কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করে রাতের আঁধারে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতাম, আমার যারা ছোট তাদেরকে আনা নেওয়া করতাম সেই ভেলাতে করে।বড় ভাইয়েরা, বাবা ও চাচাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তখন, তাঁদের জন্য গোপন জায়গায় খাবার নেওয়া, অন্যান্য রসদ যোগানো কাজ আমরা ছোটরা করতাম। দীর্ঘ ৯ মাস কালীন যে যুদ্ধ হয়েছে তার পুরো সময়টা আরও অনেক মুক্তি বাহিনীদের সাথে থেকে তাঁদের ছোটখাটো কাজে সাহায্য করা ও শরনার্থীদের ডাব, কাঁঠাল এমনকি খাবার দেওয়া এগুলো ছিল আমার/আমাদের কাজ। আমাদের গ্রামে রাজাকার ছিল কিনা মনে নেই তবে দুটো পরিবার মুসলিমলীগ করত এবং এলাকার সবাই তা জানতো তখন। আমাদের পরিবারের মুরব্বিরা প্রায় সবাই মারা গেছেন যারা সত্যিকার মুক্তি যোদ্ধা ছিলেন এবং তাঁরা সবাই সরাসরি যুদ্ধ করেছেন।আমাদের বড় ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতে ট্রেনিংয়ের জন্য যান। তখন কেউ জানতো না কতদিন এ যুদ্ধ চলবে। আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করা, তার জন্য ভালো ট্রেনিং দরকার বিধায় ভারত সরকার তখন এ সুযোগ করে দেয়।ছয় মাস ট্রেনিং করে আমার ছোটকাকা এবং এক ভাই ফিরে এসে যুদ্ধে যোগদান করেন এবং কারও কারও ট্রেনিং শেষ হবার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায় বিধায় তাঁরা ফিরে আসেন দেশে এবং কেউ কেউ আবার ফেরেননি,যারা ফেরেনি তার মধ্যে ছিলো আমাদের এক ভাই নাম রাসেদ, রাসেদ ভাই কোথায়,কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো আমরা কেউ তা এখনো জানি না। এই মূহুর্তে মনে হচ্ছে এই তো সেদিনের কথা।যুদ্ধ শেষ হল, শুরু হল দেশ গড়ার কাজ। সব কিছু নতুন করে গড়তে হবে। আমাদের নহাটার বাজারে আমাদের এবং আমাদের বংশের মানুষের বেশির ভাগ ঘর দুয়ার। যেহেতু নহাটায় হিন্দু বসতি বেশি ছিল তাই এলাকায় তাঁদেরও অনেক ঘর দুয়ার ছিল নহাটা বাজারে, (নহাটা, মাগুরা জেলা)। যুদ্ধে পুরো বাজার রাজাকারদের সাহায্যে পাকবাহিনী পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলে, তাই যুদ্ধের পরে স্বাধীন দেশে শুরু হয় নতুন সংগ্রাম, দেশ গড়ার সংগ্রাম।আবার নতুন করে আমরা তৈরি করেছি সেই নহাটা বাজার যে বাজার বাংলাদেশের মধ্যে একটি আদর্শ ও ঐতিহ্যবাহী বাজার, যেখানে গো হাঁট থেকে শুরু করে সব ধরনের বেচাকেনার ব্যবস্থা রয়েছে, নহাটা বাজার নবগঙ্গা নদির পাড়ে যেখানে কেটেছে আমার শিশু এবং কৈশোর কাল। আজ এসব কথা মনে পড়ছে যখন কিছু সাংবাদিক বন্ধুরা জানাল দেশে ভীষন আকারে গোলমাল হচ্ছে চাকরীর “কোটা”নিয়ে।

আমি এখনও জানিনে আমাদের গ্রামের কত% মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান, আমি এটাও জানিনে আমাদের পরিবারের কেউ এমন কোন সুযোগ সুবিধে পেয়েছেন কিনা বা পাচ্ছেন কিনা। আমরা পড়াশুনো যতটুকু সম্ভব দেশে করে পরে বিদেশে চলে এসেছি, তবে দেশ স্বাধীনের পরেওতো ১৫ বছর দেশে ছিলাম “কোটা “ বলে তখন কিছু ছিলো বলে জানতাম। “কোটা”কেন এবং কাদের জন্য তা জাতীয় সংসদে আলোচনা করে পাশ করা হয়েছে। কিন্তু কতজন তা পড়েছে বা জেনেছে আজো তা আমি জানি নে এবং একদিন তার জন্য গৃহ যুদ্ধ হবে সেটাও জানতাম না।তবে একটি কথা মনে পড়ে যখন শেখ মুজিব বলেছিলেন “সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম আমার আর আমার বৌয়ের কম্বল কোথায় গেলো? তেমনটি ঘটেছিল আমাদের বেলাতে কারন আমার কাকা তখন চেয়ারম্যান এবং আমার মা মেম্বর সত্ত্বেও আমরা কম্বল পাইনি । কারন ছিলো একটাই আমাদের থেকে গ্রামের অন্য লোকদের অবস্থা তখন আরো খারাপ ছিলো। মনে হয়েছিল সামান্য কম্বল তা যার বেশি দরকার তারই প্রাপ্য। বাবা চাকরিতে ফিরে গেলেন দেশ স্বাধীনের পরে, মা তখন গ্রামের মেম্বর, সাথে মহিলা সমিতির সভানেত্রী, দেশের সেই দুর্দিনে সংগ্রাম করেছেন কীভাবে মহিলাদেরকে কিছু লেখাপড়া শেখানো যায় এবং তার জন্য শুরু হল রাতের স্কুল আমাদের বাড়িতে।

দেশের জন্য এতো কিছু করে পরিবারের ভালোবাসার মানুষদের হারানোর পরেও “কোটার”কথা শুনিনি যা শুনছি এত বছর পরে, শুধু তাই নয়, তার জন্য চলছে রীতিমত যুদ্ধ! অথচ আমি আমার সেই মৃত বাবা/ মার শুরু করা সুশিক্ষার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুরোধ করছি। কিন্তু সুশিক্ষার পিছনে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ছে না, তারা ঝাঁপিয়ে পড়ছে শিক্ষাঙ্গনের গুরজনদের উপর, হাসপাতালের সামনে যেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে আমাদেরই নিজেদের আপনজন,
আজ চাকরীর কোটাসহ নানা কারনে মানুষে মানুষে বড় বিভেদ। আমরা মানুষ নামের পরিবর্তে নামধারন করেছি কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএন পি, কেউ বা অন্য কিছু। আজ জাতি সত্যিকারের শিক্ষা হারিয়ে ফেলছে। সুশিক্ষা, মানসম্মত শিক্ষার অভাবে যে সামান্য সুযোগ সুবিধে দেশে রয়েছে তার দিকে চেয়ে আছে লক্ষ লক্ষ বেকার। চাকরিতে লোক নিয়োগ হবে একজন, হাজার প্রার্থী তাতে আবেদন করছে। “কোটা” থাকা সত্ত্বেও হবে কি চাকরি সবার? যারা চাকরি পাবে না তাদের কর্মসংস্থানের জন্য কী ভাবা হচ্ছে? দেশে লক্ষ লক্ষ বেকার তৈরির এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কি কোন জবাবদিহিতা আছে?
সরকারের কী বক্তব্য এই ব্যপারে? ঘটনার পরে, ভাবনা একটাই মনের মাঝে, কীভাবে সম্ভব একটি বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়, যেখানে জাতি তার উত্তর খুঁজে বের করবে, কী পড়াব, কতটুকু পড়াব, কতজনকে পড়াব, দেশের কতটুকু কী দরকার? চাহিদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ মানসম্পন্ন প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি হবে সুশিক্ষিত জাতি। থাকবে না কোন বেকারত্ব।চাকরীর জন্য কোন ভাঙচুর, যুদ্ধ করতে হবে না।

প্রিয় দেশবাসী আবারও অনুরোধ সুশিক্ষার জন্য ঝাপিয়ে পড়ো। মা/বাবা যে কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি,আজ সেই কাজ করার স্বপ্ন চলেছে যেন এক “নেভার এনডিং জার্নি”।কবে শেষ হবে এ “জার্নি“ তা জানিনে তবে চলতে থাকবে…

– রহমান মৃধা,পরিচালক ও পরামর্শকারী,গ্লোবাল ফার্মাসিউটিালস, সুইডেন।